Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। তিন ।।

রতন যেখানে থাকে সেটা এক কথায় নিম্নবিত্ত লোকেদের থাকার জায়গা। সেখানে কেউ কারুর বিষয়ে মাথা গলায় না। বাঁচার লড়াই করতে করতে সারাদিন পার হয়ে যায়। রতন সকাল বেলায় বের হয়ে যায়। সারাদিন কারখানায় কাজ করে। রাতে এসে কিছু খেয়ে শুয়ে পরে। এই ঘরে না আছে সেইরকম কোন আসবাবপত্র না আছে কোন আব্রু। রতন তারই মধ্যে শম্পাকে এনে তুলল।

দুই ঘর পার হয়ে এক বৃদ্ধা থাকে। দেখা হলে সেই মাঝে মাঝে রতনের খোঁজ খবর নেয়। রতন কখনো সখনো এটা-সেটা এনে দেয় সেই বুড়িকে। সে এখনো শম্পাকে দেখে নি। দিন কয়েক পরে একদিন রতনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই চলে যাওয়ার পরে তোর ঘরে কাউকে দেখলাম যেন সেইদিন। কেউ এসেছে নাকি? দরজা ভালো করে লাগিয়ে রেখে যাস বাবা। দিনকাল যা পড়েছে। রতন হ্যাঁ-না কিছু একটা বলে সেখান থেকে কেটে পড়েছিল।

সেদিন রবিবার। রতনের কারখানা সেদিন বন্ধ। রতন ঠিক করল আজ শম্পার কাছ থেকে সব জানবে। এইভাবে বেশী দিন থাকা ঠিক না। সকাল বেলা মোড়ের দোকান থেকে চা-কচুরি কিনে এনে দুটো প্লেটে সাজিয়ে, একটা নিজে নিল আরেকটা শম্পাকে দিল। তারপর চায়ে দুই চুমুক দিয়ে শম্পাকে জিজ্ঞেস করল, তোর বিয়ে হয়েছিল শুনেছিলাম। তারপর আর কোন খবর পাই নি। কয়েক বছর পরে তোর বাড়ির সবাই কোথায় চলে গেল তাও জানি না। তারপর সেদিন রাতে তোকে ওই অবস্থায় কে ফেলে গিয়েছিল? সবটা জানলে তোর থাকার একটা ঠিকঠাক ব্যবস্থা করতে পারি।

শম্পা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার এই অবস্থায় তুমি যে এই কয়দিন আমাকে থাকতে দিয়েছ তা আমি কোনদিন ভুলব না। তারপরে একটু মুচকি হেসে বলল, অবশ্য আমি তোমাকে কখনই ভুলি নি। তোমার জন্য কত বকা খেয়েছি। আমার সবই মনে আছে।

এক মুহূর্তে রতন অনেক পুরানো দিনে চলে গেল।  একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, তোর এক মামা ছিল না? বাংলাদেশ থেকে কিসব চালানের ব্যবসা করত? একবার শুনলাম, কিসব মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে…

কথা শেষ হওয়ার আগেই শম্পা চায়ের কাপটা ঠকাস করে নামিয়ে রেখে বলল, ও যতদিন জেলে আছে ততদিনই ওর আয়ু। জেল থেকে বের হলে ওকে আমি খুন করব। তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না আমার বিয়ের কথা? তাহলে শোনো।

রতন দেখল মামার কথা ওঠা মাত্র শম্পা অন্যরকম হয়ে গেল। শম্পা বলল, আমাদের বাড়ির অবস্থা তো তুমি জানতেই। একদিন আমার বিয়ে দেবে বলে মামা একটা সম্বন্ধ নিয়ে এল। তার কয়েকদিন পরে তারা সপরিবারে আমাদের বাড়িতে এল। পরে জেনেছিলাম ওই লোকগুলো ওর সাগরেদ। গাণ্ডেপিণ্ডে খেল, তারপর চলে গেল। কয়েক সপ্তাহ পরে মামা এসে বলল ছেলেটা একটা বড় চাকরি পেয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে হংকং চলে যাবে। যাওয়ার আগে ওর বাড়ির লোক ওর বিয়ে দিতে চায়, অথচ হাতে সময় নেই। তাই রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বউ নিয়ে বিদেশ যাবে। পরে ছুটিতে এসে বড় করে অনুষ্ঠান করবে। আমাকে দেখে নাকি ওদের সকলের খুব পছন্দ। তাই ওরা মামাকে টেলিগ্রাম করে খবর পাঠিয়েছে। সেই টেলিগ্রাম আমিও দেখেছিলাম। বাবা তখন অসুস্থ। মা মানা করেছিল। কিন্তু মামার চাপাচাপিতে একসময় মা রাজি হয়ে গেল। বিশেষ করে যখন বলল, রেজিস্ট্রি করে যখন বিয়ে হবে, কোন চিন্তা করার কারণ নেই। মামা বাবা-মাকে বলেছিল, মামা নিজে থাকবে সেইখানে আর মামার জানাশোনা রেজিস্ট্রি অফিসারকে দিয়ে রেজিস্ট্রি করাবে।

তখন আমার বয়স কম। তার উপরে বাড়ির ওই অবস্থা। এদিকে ভালো ছেলে, বিয়ে করেই বিদেশে যাব। সব মিলিয়ে আমি কেমন যেন জাদু মন্ত্রের পুতুলের মত হয়ে গেলাম। একটা ঘোরের মধ্যে দুইদিন কাটল।

একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শম্পা বলল, বাড়ি থেকে বলে নিয়ে গেল কলকাতা যাবে। নিয়ে গেল ধানবাদ। তখন সবই এলোমেলো, কোনটাই ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল না। যেইটাই জিজ্ঞেস করি সবেরই একই উত্তর। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, কলকাতা যাওয়ার কথা, ধানবাদে নিয়ে এলে কেন? বলল, এত বড় কাজের দায়িত্ব নিয়ে হংকং যাবে। এখন কি সব নিয়ম মেনে চলা সম্ভব? তোরা এখনকার মেয়ে। তোরা যদি এইসব নিয়ে পরে থাকিস তো কি করে চলবি হংকঙের মত জায়গায়?

ধানবাদে পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় দিন সন্ধে বেলায় মামা যেই বাড়িটাতে আমাকে নিয়ে উঠেছিল সেইখানে একটা এই বছর তিরিশের কাছাকাছি বয়সের একটা লোক এল। মামা আলাপ করিয়ে দিল, তার নাম শোভন দত্ত এবং সেই আমার হবু বর। আমি মামাকে ইশারায় ভিতরের ঘরে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ইনি তো আমাদের বাড়িতে যান নি।

মামা বলল, যে গিয়েছিল সে শোভনের ভাই। শোভন কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে সময় করে উঠতে পারে নি। তারপরে বলল, আরে, তুই কি? আমি তো নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম প্রথমে। পরে আমি গিয়ে বললাম, শোভন যতই ব্যস্ত থাক, ওকে সময় করে আসতেই হবে। যারা বিয়ে করবে তারা দু’জন দু’জনকে ভালো করে জেনে বুঝে নেবে না তাই কখনো হয় নাকি? বিয়ে যদি করতে হয় তো শোভনকে আসতেই হবে। তখন ওর বাড়ি লোকজন শোভনের সাথে কথা বলে জানালো যে, আজ শোভন ধানবাদে থাকবে।  সন্ধের পর শোভনের কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। শোভনই এই গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বুঝতেই পারছিস কত ব্যস্ত লোক। এইবার বুঝলি তো কেন কলকাতা না গিয়ে ধানবাদে আসতে হল।

তারপর আমি যখন চা নিয়ে গেলাম দেখি কোত্থেকে মদের বোতল বের করে মদ ঢেলে খেতে শুরু করে দিয়েছে। আমি মামার দিকে তাকালাম। মামা ইশারা করে চুপ করে যেতে বলল আমাকে। আমি তবুও চা এগিয়ে দিলাম।

কথায় খুব কেতা দুরস্ত সে বাবু। ভারী গলায় বলল, Thank you. You didn’t need to do that.

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে কাপটা সরিয়ে রেখে দিল। আর মদ খেতে লাগল। দেখে আমার ভীষণ বিরক্তি লাগল। আমার মনে তখন নানান চিন্তা, হাজারো প্রশ্ন, অনেক স্বপ্ন। আর সবটাকে ঘিরে একটাই ভয়, আমি পারব তো? এই রকম বাড়িতে আমি আগে কখনো থাকি নি। এরপরে হংকং-এর মতন একটা জায়গা। তার সাথে এইরকম একটা লোক। আমার মাথা বোঁবোঁ করে ঘুরছে তখন। শোভন মামার সাথে কি সব কথা বলতে লাগল। ঠিক বুঝলাম না।

একসময় মামা বলল, তোরা একটু কথা বার্তা বল। আমি একটু আসছি। আমাকে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দে। দরজার কাছে আমাকে বলল, এই রকম ছেলে লাখে একটা পাওয়া যায় না। বুঝতেই পারছিস কি রকম পজিশন ওর। তুই গেয়োমি করে আমাকে ডুবাস না। Behave like a modern girl.  এই বলে চলে গেল। আমি দরজা লাগিয়ে এসে বসলাম শোভনের সামনের সোফায়। কিছু বলব, নাকি চুপ করে বসেই থাকব – এই ভাবছি তখন। আড় চোখে দেখছি শোভন একটু একটু করে মদ খেয়ে যাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপরে একটা সিগারেট শেষ করে সেই ভারী গলায় বলল, Come on darling. We will be married soon. Don’t be shy to me. মামার কথা মনে পড়ল। Behave like a modern girl. অনেক সাহস করে শোভনের পাশে গিয়ে বসলাম বটে, তবে ভয়ে উৎকণ্ঠায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল। শক্ত হয়ে বসে থাকলাম। তারপর শোভন আর বেশী কথা বলে নি। যা করল, তা তোমার কাছে মুখ ফুটে বলতে পারব না। তখন রাত, অচেনা জায়গা। বাড়ি থেকে পালানোর কোন জায়গা আমার জানা নেই। সে যে কি অত্যাচার, কি কষ্ট, কি দুঃখ – ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

পরের দিন সকালে মামা এল। মামাকে যতটা পারলাম বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, সারারাত কোথায় ছিলে? মামা বলল, মাঝ রাস্তায় গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। কোথাও একটা মেকানিক পাই না…। তারপর তার নানান বর্ণনা। আমি বললাম, আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। মামা বলল, নিয়ে তো যেতে পারি। এখনই নিয়ে যেতে পারি। ওখানে গিয়ে কি করবি? শোভনের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে এগুলো তখন আর আলাদা কিছু মনে হবে না। হাই-সোসাইটিতে এইসব এক-আধটু হয়েই থাকে। মনে রাখ, তুই এখন আর ভীমপুরের গ্রামের মেয়ে নস। এই নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর হবু বর তোর সাথে একটু ফষ্টি নষ্টি করেছে। কয়দিন পরে বিয়ে। বিয়ের পর এসব হলে কি তুই আমাকে এসে নালিস করতিস?

তারপরে না-পেলাম শোভনের দেখা, না মামার কাছে শোভনের নাম শুনলাম। দুই দিন এইভাবে গেল। এরমধ্যে মামার কাছে টুকটাক লোকজন দেখা করতে আসত। আমি লজ্জায় আর ভয়ে বের হতাম না। সারাক্ষণ সেই রাতের কথা ভাবতাম আর বিয়ের পরে কি হতে পারে সেই নিয়ে কল্পনা করে আতঙ্কে শিউরে উঠতাম। দুইদিন পরে মামাকে বললাম, কই? তার তো আর কোন দেখা পেলাম না, কোন কথাও শুনছি না। মামা বলল, হংকং যাওয়া ও এখন নিয়ে খুব ব্যস্ত। তারপরের দিন সেই বাড়ি ছেড়ে অন্য এক জায়গায় উঠলাম। মামা বলল, ওটা শোভনের অফিসের গেস্ট হাউস। সেখানে বেশী দিন থাকা ভাল দেখায় না। এইটে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। ওরা কাল বেড়াতে গেল। তোর বিয়ে না-হওয়া পর্যন্ত এইখানে থাকব।

দুই দিন পরে সন্ধের সময় মামার ব্যবসার কিছু বন্ধু এলো। মামা বাইরে থেকে অনেক খাবার নিয়ে আনালো। আমাকে বলল, এরা সবাই শোভনের বন্ধু, আমার সাথে ব্যবসার খাতিরে আলাপ। আজ ওদের খাওয়াতে হবে। তুই খেয়ে শুয়ে পড়িস। খাওয়ার পরে আমি যে ঘরে শুই সেখানে চলে গেলাম। ওদের কথাবার্তা এক-আধটু শুনতে পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছিল, কানে আসছিল তবে বুঝতে পারছিলাম না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই নি।

টের পেলাম যখন তখন বুঝলাম, তিনটে লোক আমাকে চেপে ধরে রেখেছে। আমি মামা বলে একটা চিৎকার করতেই একজন গালের উপরে এমন জোরে থাপ্পড় মারল যে আমার প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা হল। আমাকে নিয়ে তাদের তাণ্ডব যখন শেষ হল, আমি অসাড় হয়ে পরে থাকলাম। তারপরে মামাকে আর দেখতে পাই নি। মাস দুয়েক আমি ওই বাড়িতে বন্দি ছিলাম। নানান লোকের শখ মেটাতে মেটাতে আমি তখন একটা জড় পদার্থ হয়ে গিয়েছিলাম। বাধা দিলে বা অমান্য করলে, মার খেতে হত। একবার ভেবেছিলাম কোনরকমে একবার সেখান থকে বের হতে পারলে পুলিশের কাছে যাব। সেই রাতেই দুইজন পুলিশ এল আমার বিছানায় অতিথি হয়ে। তখন বুঝলাম, সে রাস্তাও আমার আর খোলা নেই।

শম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপরে বলল, এরপরে কিছুদিন এই বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। কি ভাবে যে যেতাম আর কেনই বা যেতাম বুঝতাম না। বুঝেছিলাম অনেক পরে। আমাকে কেনা বেচা হত। আর আমার মালিকানা বদলে যেত কয়েকমাস অন্তর অন্তর। তারপর যখন বুঝলাম, এটা one way traffic, ফেরত যাওয়ার কোন পথ নেই, অনেক বুদ্ধি করে একদিন নিজেই নিজের মালিক হয়ে গেলাম।

কিন্তু কি জান? ব্যাপারটা একই। এর মধ্যে থাকলে, সব ঠিকঠাক চলবে। বের হতে গেলেই ওই রকম, মেরে পিটিয়ে ছাইয়ের গাদার মধ্যে ফেলে চলে যাবে।

তোমার সাথে যে দেখা হবে একথা কোনদিন ভাবি নি। এখন ভাবছি, তোমার সাথে দেখা না-হলেই ভালো হত, নাকি এইগুলো না-বললেই ভালো করতাম।

রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের শেষ চুমুক মেরে শম্পার কাছে এল। ওর হাতের ব্যান্ডেজটা খুলতে খুলতে বলল, আজ ওষুধ লাগাতে হবে। শম্পা ব্যথায় হোক বা অস্বস্তির কারণেই হোক হাতটা বারবার টেনে নিচ্ছিল। রতন বিরক্ত হয়ে বলল, ওই যে ভুত!

শম্পা একটু চমকে উঠে তারপরে খুব শান্ত গলায় বলল, তোমার মনে আছে, লালপুরের মাঠে একদিন স্বপন না কে যেন ভুত সেজে আমকে ভয় দেখিয়েছিল। আর সেই ভয়ে আমি তোমাকে জাপটে ধরেছিলাম। তারপরে বুঝতে পেরে লজ্জায় দৌড়ে পালিয়েছিলাম। আজ আমার চারপাশে অনেক ভুত। ওই রকমভাবে ভয় দেখিও না। ভউ পেয়ে এখন একবার যদি তোমাকে আমি জাপটে ধরি আর ছাড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। তারপর একটু গম্ভীর স্বরে বলল, আজ আমি ধরলে তোমার গায়ে যে ছাপ লেগে যাবে তা মুছতে পারবে না।

শুনে রতনের বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। শম্পা বলল, আস্তে আস্তে খোল, এখনো ব্যথা আছে। অন্যদের অত্যাচার অনেক সয়েছি। তবে তোমার কাছ থেকে এলে সেইটা একটু বেশী কষ্টের হবে। এই বলে হাতটা রতনের কাছে এগিয়ে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8