Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। দুই ।।

রতন ঘরে ফেরার পথে সারাক্ষণ সোনালির মুখটা ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকল। চেনা চেনা লাগে, অথচ ওই নামে কাউকে চেনে বলে ওর মনে পড়ল না। পরের দিন কাজের চাপে সারাদিন কেটে গেল। তারপরের দিন বিকেল বেলায় হাসপাতালে যাওয়া মাত্র একটা নার্স বলল, কাল আসেন নি কেন? আপনার আত্মীয়াকে কালই ছেড়ে দেওয়ার কথা। আজ না-এলে আমাদের ওকে বের করে দিতে হত। এখন বাড়ি নিয়ে গিয়ে ওকে সাবধানে রাখবেন।

“আত্মীয়া” শুনে রতন একটু চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নিল। নার্সের দিকে তাকিয়ে শুধু “আচ্ছা” বলে সোনালির বেডের দিকে চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে সোনালির সাথে অন্য এক পেসেন্ট বিছানা ভাগাভাগি করে শুয়ে আছে। রতন বলল, চলুন।

সোনালি তৈরি ছিল। রতন হাসপাতালের রেজিস্টারে একটা সই করে সোনালিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এল। রতন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন?

সোনালি কিছু না-বলে রতনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। রতন কিছুটা আশ্চর্য আর অনেকটা বিরক্ত হয়ে সোনালিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। দেখল সোনালির মাথার ব্যান্ডেজটা খুলে দিয়েছে। সারা মুখে ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রতনের আবার মনে হল, যেন ওর খুব চেনা কেউ, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না। অনেকের সাথে এই মেয়েটাকে মেলাতে চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই পারল না। মেলাতে না-পারার অস্বস্তিটা যত বাড়তে লাগল, রতনের ভিতরে ভিতরে বিরক্তিটাও তত বাড়তে থাকল। সোনালি বলল, আপনার বাড়িতে কে আছে?

রতন বলল, কেউ নেই। একাই থাকি।

সোনালি বলল, আমি যেখানে থাকি সেইখানে আমি ফিরে যেতে পারব না। আমার অবস্থা দেখে তো সেটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন। এখন হুট করে একটা বাড়ি কি করে পাব? আপনি কয়েকদিনের জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিন।

রতন বলল, আমার জানাশোনা তেমন কেউ নেই যার বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। আর কাউকে পেলেও, আপনার সম্বন্ধে কি বলব?

সোনালি বলল, কেন? বলবেন আমি আপনার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। ভীমপুর থেকে কলকাতায় কোন কাজে এসে এক্সিডেন্ট হয়ে এই অবস্থা। টাকা-পয়সা সব চুরি হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে আপনি এসেছিলেন। কয়েকদিন পরে চলে যাবে। তার মধ্যে আমি একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারব।

রতন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ভীমপুরে থাকেন নাকি?

সোনালি বলল, এখন থাকি না, আগে থাকতাম। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, আপনি কতদিন হল কলকাতায় এসেছেন?

রতন চমকে উঠল। পুরানো বইখাতার ভিতর থেকে ছোটবেলার একখানা ছবি অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে এলে যেরকম একটা কষ্ট মেশানো অনুভূতি হয়, রতনের সেই রকম অবস্থা হল। আশ্চর্য হয়ে সোনালির দিকে তাকিয়ে ওর স্মৃতির মধ্যে সোনালিকে মেলাতে চেষ্টা করল। তারপর অধৈর্য হয়ে একটু জোরেই জিজ্ঞেস করল, আপনাকে আমার সেইদিন থেকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি কে বলুন তো?

সোনালি বলল, যখন আপনি আমাকে হাসপাতালে এনেছিলেন আমার কোন হুঁশ ছিল না। কিন্তু আপনার তো ছিল। পরেরদিন এলেন আমাকে দেখতে। আজও এলেন। এখনো শম্পাকে চিনতে পারলে না রতন-দা?

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে জলকাদা জমে থাকা রাস্তা পার হওয়ার সময় যদি একটা বড় বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, তখন সেই আলোতে যেমন পুরো রাস্তাটা মুহূর্তের জন্যে পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়, রতনেরও ঠিক তেমনি অতীতের অনেককিছু এক মুহূর্তে মনে পরল।

সোনালি বলল, ভীমপুরের শম্পাকে তুমি ভুলে গেছ রতন-দা। আমাকে দেখেও চিনতে পারলে না এতক্ষণে।

রতন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এক-পা পিছিয়ে গেল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, আপনি যে বললেন আপনার নাম সোনালি।

শম্পা বলল, সেইটেই আমার এখনকার নাম। ওই নামই লেখা আছে হাসপাতালের রেজিস্টারে।

– আপনি কি সত্যি আমাদের ভীমপুরের শম্পা? শম্পার তো বিয়ে হয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল। তারপর কেউ আর তার খোঁজ পায় নি।

শম্পা সে কথার উত্তর না দিয়ে অনেকটা আবদারের সুরে বলল, রতন-দা আমাকে কয়েকদিন থাকার একটা জায়গা খুঁজে দাও এখন।

– তোর বর, শ্বশুরবাড়ি – সেসব কোথায়? সেখানে চল। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

– সে সব নেই। পরে বলব। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

– কিন্তু আমার জানা তেমন কেউ নেই যেখানে তোকে রাখতে পারি।

– তাহলে তুমি যেখানে থাক, সেইখানেই চল। কয়েকদিনের মধ্যে একটা বাড়ি খুঁজে চলে যাব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8