Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। এক ।।

তখন প্রায় মাঝরাত। রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি হুস-হাস করে যাচ্ছে। সকাল থেকে আবহাওয়া গুমোট হয়ে আছে; আকাশে দুই-এক টুকরো মেঘ থাকলেও রাতে বৃষ্টি হওয়ার কোন আশা নেই। দোকান-পাট সব অনেকক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের ছাইয়ের গাদার পাশে কয়েকটা কুকুর ঝিমোচ্ছে।

এমন সময় রতন হাঁটতে হাঁটতে এসে চায়ের দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে এসে বসল। গায়ের জামাটা খুলে সেটাকে হাত পাখার মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটু হাওয়া খেল। বেঞ্চের পেছন থেকে একটা কুকুর উঠে তখন রতনের পায়ের কাছে এসে গায়ে লেগে থাকা ছাই ধুলো ঝেড়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল – আশায় – যদি কোন খাবার পাওয়া যায়। রতন হাওয়ায় জামাটা একটা ঝাড়া দিয়ে কুকুরটাকে তাড়িয়ে জামাটা পরে উঠে দাঁড়াল। এক-পা এগোতেই কোত্থেকে একটা অস্ফুট শব্দ রতনের কানে এল। শব্দটা চাপা, অনেকটা গোঙানির মতন। রতন দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে তাকালো। সারা রাস্তা ফাঁকা। কুকুরটা ততক্ষণে অনেকটা দূরে গিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাশের কোন রাস্তা দিয়ে ভট-ভট করে একটা মোটর সাইকেল চলে গেল। রতন চারপাশ দেখে দুই-তিন পা এগোল। আবার সেই ক্ষীণ শব্দটা রতনের কানে এল। রতন এবার ঘুরে দাঁড়াল। জীবনে এমন সব চরাই-উৎরাই পথ দিয়ে রতন এসেছে যে ভুত-প্রেতের প্রতি কোন ভয় নেই তার। রতন আবার শুনতে পেল সেই শব্দ। তখন সেই শব্দটাকে আন্দাজ করে রতন ফিরত এলো – চায়ের দোকানের পাশে যে গলিটা চলে গেছে সেইখানে এসে উঁকি মারল। দেখতে পেল এক মহিলা রাস্তায় পরে আছে। রতন আশেপাশে চারিদিকে দেখল – কোথাও কেউ নেই। রতন মহিলাকে তুলে নিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চে শুইয়ে দিল। মেয়েটার শরীরে নানান জায়গা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে; প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা।

অনেক চেষ্টা করে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে মহিলাকে কাছাকাছি এক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে তাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রতন যখন বাড়ি পৌঁছল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। রতন স্নান করে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কাজের ক্লান্তি, তারপর সারারাতের ধকলে শোয়া মাত্র রতন ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। রতন ঠিক করল সেদিন আর কাজে যাবে না। এমনিতে বেলা হয়ে গেছে, তার উপরে একবার হাসপাতালেও যেতে হবে।

কিছু খেয়ে নিয়ে রতন হাসপাতালে গেল। প্রথমেই পড়ল পুলিশের হাতে। অনেক জেরার শেষে, পুলিশের খাতায় ওর বাসার ঠিকানা, কাজের ঠিকানা সব লিখে তখনকার মত রেহাই পেল। তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। রতন গেল সেই মহিলার সাথে দেখা করতে। রতন যেই মহিলার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, মহিলা জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি আমাকে কাল হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন?

রতন মাথা নাড়িয়ে জানালো, হ্যাঁ। রতন দেখল মহিলার গলা অবধি চাদর দিয়ে ঢাকা, মাথায় গজ দিয়ে মোটা করে বাঁধা। মুখে নানান জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে। মহিলার কথার মধ্যে যন্ত্রণার প্রকাশটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। রতন জিজ্ঞেস করল, আপনি কিছু খেয়েছেন দুপুরে? কিছু এনে দেব কি?

মহিলা বলল, খেয়েছি। কিছু চাই না। ধন্যবাদ।

রতন জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি? কোথায় থাকেন? বাড়ির কাউকে খবর দিয়েছেন কি?

শুনে মহিলা একটু চমকে উঠে মাথাটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে রতনের দিকে ফিরে বলল, আমার নাম সোনালি; একাই থাকি। আমার কেউ নেই যে আপনি তাদের খবর দেবেন।

মহিলার মুখখানা রতনের খুব চেনা-চেনা মনে হল তবে ওই নামে কোন মেয়েকে ওর মনে পড়ল না। মহিলা জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কি পুলিশ আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

কালকের ঘটনা, মহিলার বেশভূষা, কথাবার্তা, সবমিলিয়ে রতনের মনে অনেক খটকা ছিল। এই মহিলার মুখ থেকে এই প্রশ্ন শুনে রতন প্রথমে একটু থতমত খেলেও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এক ঘণ্টা ধরে ওদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই ছাড়া পেলাম। আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি তো আপনার কিছুই জানি না যে কিছু বলতে পারব। কালকের ঘটনাটা বললাম। তবে কেন জানি না, আপনার ব্যাগটার কথা বলিনি। ওটা আমার কাছে আছে। কাল দিয়ে যাব।

মহিলা বললেন, ধন্যবাদ। ও নিয়ে আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনি গতকাল যা করেছেন, তা না-করলে আমার আর কোনদিনই ওই ব্যাগের দরকার হত না।

রতন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, আপনার কোথায় কেটেছে বা ভেঙ্গেছে? কিন্তু কোন অপরিচিত মহিলাকে এই সব জিজ্ঞেস করা ঠিক নাও হতে পারে ভেবে, কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

মহিলা একটু হেসে উত্তর দিল, না, ওইটুকু আমার সহ্য হয়।

রতন কোন কথা খুঁজে না পেয়ে পাশ থেকে একটা স্টুল টেনে বসল। একবার ভাবল, কাল কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করে? কিন্তু সম্ভাব্য কোন অস্বস্তিকর ঘটনার কথা ভেবে কিছু জিজ্ঞেস করল না। চুপ করে বসে থাকল। এমন সময় এক নার্স এসে বলল, ভিজিটিং ওয়ার্স শেষ। রতন উঠে দাঁড়াল। বলল, সাবধানে থাকবেন। পরশু আসব। কাল কাজে না গেলে চলবে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8