।। নয় ।।
সেদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে রত্নাকরের কি-করি কি-করি করতে করতে ভাবল একটু ঘুমিয়ে নেয়। এই অবস্থায় গল্পের বইয়ের মত ভাল ওষুধ আর হয় না। একখানা গল্পের বইয়ের কয়েক পাতা পড়তে না-পড়তেই রত্নাকর ঘুমিয়ে পড়ল। গল্পের বইটা কখন উল্টে পরে গেছে তার কোন হুশ নেই। ঘুম ভাঙল দরজার টোকা দেওয়ার শব্দ শুনে। বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখে জুঁই দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাকর বলল, ‘ভিতরে এসো।’ জুঁই ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, ‘ঘুমচ্ছিলেন নাকি?’ ‘কিছু করার নেই। একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ ‘আজ হঠাৎ যা গরম পড়েছে’, বলে জুঁই রুমাল দিয়ে নিজের মুখ মুছল। তারপরে বলল, ‘এক গ্লাস জল খাওয়ান তো।’ ‘জল খাবে, না ঠাণ্ডা খাবে?’ ‘আছে?’ ‘না। নিয়ে আসছি সামনের দোকান থেকে’, বলে জুঁইকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়েই রত্নাকর বেরিয়ে গেল।
জুঁই বিছানার পাশে পরে থাকা গল্পের বইটা তুলে ঠিক জায়গায় রাখতে গিয়ে দেখতে পেল একটা খাতা। তাতে অনেক গানের লাইন লেখা আছে। তার কয়েকটা পাতা একটু দেখে খাতাটা জায়গা মত রেখে দিল। তখনই রত্নাকর দুটো লিমকার বোতল নিয়ে ফেরত এল। একটা জুঁইকে দিল আরেকটা নিজের পাশে রাখল। জুঁই একটু লিমকা টেনে বলল, ‘আপনি কি গান লিখে রাখেন?’ ‘তোমার কাছ থেকে ওই রোগটা ধরেছিল। ছিল কয়দিন। এখন আর লিখি না।’ ‘তা রোগটা কোন অ্যান্টিবায়োটিকে সারলো?’ ‘কেন তোমার মনে নেই?’ ‘কি?’ ‘তোমার জন্মদিনে খেতে গিয়ে গানের কথায় তোমার দিদি কিরকম মুখ গুম করে বসেছিল।’ জুঁই হাসতে হাসতে, ‘বুঝলাম, ভেরি স্ট্রং অ্যান্টিবায়োটিক! কি বলেন?’ বলে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে আবার একটু লিমকা টানল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি আমার দিদিকে ভালোবাসেন?’
প্রশ্নটা শুনে রত্নাকর একটু হকচকিয়ে গেল। সেটা ঢাকতে পালটা প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি মনে হয়?’ ‘আপনাকে দেখার আগে দিদির কাছে আপনার এত গল্প শুনেছি যে আমি ভাবতাম দিদি আপনার সাথে প্রেম করে। এমনকি সিনেমা দেখতে যাওয়ার দিন অবধি তাই ভেবেছিলাম। আপনার সাথে যাওয়ার জন্যে দিদি কিরকম সেজেছিল মনে আছে?’ ‘সেটা কি মনে না-থাকার মত কিছু। নিশ্চয়ই মনে আছে।’ ‘কিন্তু রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করতে করতে বুঝলাম দিদি এখনো সঞ্জীব-দাকে ভালোবাসে। সঞ্জীব-দার কথাতে কিরকম হয়ে গিয়েছিল মনে পরে? আপনিও তো দেখেছিলেন। আমি সব নজর করেছিলাম।’ ‘তোমার কাছে খুব সাবধানে থাকতে হবে দেখছি।’ জুঁই আবার চুক চুক করে দুবার লিমকা টানল। তারপরে বলল, ‘আমি যা ভাবি, সেটা বললাম। আপনার কথা বলেন।’ ‘আমার কি কথা?’ ‘আপনি কি দিদিকে ভালোবাসেন?’
রত্নাকর অস্বস্তিতে পড়ল। ভাবল, জুঁই কি শুধু এটাই জানতে চায় নাকি ওর অন্য কোন মতলব আছে? বলল, ‘তুমি যে অর্থে জিজ্ঞেস করছ, সেরকম কিছু না। বলতে পারো, বন্ধুর মত।’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মল্লিকা আমাকে বলেছিল যে সঞ্জীব খুব স্টিরিও-টাইপ ছেলে। ও নাকি।’ মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জুঁই বলল, ‘ওটা দিদির মনে-হওয়া কথা। সঞ্জীব-দা মোটেও সেরকম ছেলে না। দিদি ভাবে ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের চলবে না। এতদিন মিশেও আমার দিদিকে বোঝেন নি? কড়া অ্যান্টিবায়োটিক!’ বলে ভ্রু-দুটো কপালে তুলে রত্নাকরের দিকে তাকালো। রত্নাকর না-হেসে পারল না। বলল, ‘তুমি এইরকমভাবে বলছ কেন? আমার তো মনে হয় তুমি মল্লিকাকে খুব ভালোবাসো।’ ‘সেই জন্যেই তো এত চিন্তা। কাল মাও দিদিকে জিজ্ঞেস করছিল সঞ্জীব-দার ব্যাপারে। দিদির ওই এক কথা। আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমাদের কে দেখবে। এবার বুঝলেন? নানান ফিকির খোঁজে, আবার সেটা যে জোর দিয়ে করবে সে ক্ষমতা নাই।’ ‘মাসিমা কিছু বলেন না?’ ‘বলে তো। আরে দিদি একবার বললে আমি সঞ্জীব-দাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসতে পারি।’ রত্নাকর হাসি চাপতে মুখ ঘোরালো। ‘ওঃ, আপনার হাসি পাচ্ছে?’ ‘না না, হাসি পাবে কেন? তুমি যে করতে পারো সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। শুধু দৃশ্যটা কল্পনা করে হাসি পেল।’
একটু ঠোঁট ফুলিয়ে ‘আপনি না একজন’ বলে জুঁই ঠাক করে লিমকার বোতলটা টেবিলের উপরে রেখে রত্নাকরের থেকে একটু অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বসে থাকল। রত্নাকর লিমকার বোতলটা তুলে জুঁইয়ের মুখের সামনে ধরে বলল, ‘এটা একটা গানের লাইন দিয়ে বলতে পারতে। বেশ ভালো শোনাত।’ শুনে জুঁইয়ের অভিমান চলে গেল এক মুহূর্তে। বলল, ‘আচ্ছা আপনি না এই গানের লাইন দিয়ে বলাটা ছাড়বেন না।’ ‘না বাবা। তোমার দিদি যা রাগ করে তাতে। আমি আর ওর মধ্যে নেই।’ ‘দিদির সামনে কেন? যখন আমি আর আপনি থাকব।’ ‘তাও না।’ ‘আমি বললেও না?’ ‘না।’ ‘কেন?’ ‘তাহলে একটা প্রতিযোগিতা-প্রতিযোগিতা ভাব চলে আসে। তার চেয়ে তুমি বলবে, আমি শুনব – এই ভালো।’ ‘তাও তো একটু গানের লাইন ঢুকিয়ে দিলেন।’ ‘কোথায়?’ ‘ওই যে, তুমি বলবে, আমি শুনব।’ ‘সঙ্গদোষ বলে একটা ব্যাপার আছে, সেটা তো মানো।’
শুনে জুঁই হেসে উঠল। এমন সময়ে জানালায় কেউ জোরে ঠক-ঠক করে দু-বার বারি দিয়ে বলল, ‘রতন ঘরে আছিস নাকি? চায়ের দোকানে আয়।’ জুঁই ভয় পেয়ে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে রত্নাকরের চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘ওটা কি হল?’ ‘কিছু না। বিশু ছিল। আড্ডা মারতে ডাকছে।’ ‘তাই বলে এইরকম করে কেউ ডাকে নাকি?’ ‘কেউ কেউ ওইভাবে ডাকে।’ ‘ছিঃ। আমি যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’ ‘বসো এবার।’ ‘না। আপনি ওখানে বসেন। আমি এই চেয়ারে বসব।’ রত্নাকর উঠে বিছানায় বসে বলল, ‘এর পরে কেউ যদি ওই দিক থেকে ঠক-ঠক করে ডাকে?’ জুঁই উঠে রত্নাকরের পাশে এসে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম কি রতন?’ ‘ওই রত্নাকরের সংক্ষেপে রতন। ডাক নাম বলতে পারো।’ ‘রত্নাকরের থেকে ওটা অনেক ভাল। রত্নাকর, কেমন দস্যু-দস্যু নাম একটা।’ ‘ঠিক আছে। এর মধ্যে সময় পেলে একদিন কোর্টে গিয়ে রত্নাকর নামটা বদলে বাল্মীকি করে আসব।’ ‘অত কিছু করার দরকার নেই। যা আছে তাই ভালো।’ ‘কেন দস্যুর চাইতে মুনি-সন্ন্যাসী ভাল লাগে না তোমার?’ ‘না।’ ‘তারা কেমন জড়ভরত হয়ে বসে থাকে। তার থেকে আমার দস্যুই ভালো।’ ‘দস্যু হয়ে আমি যদি তোমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি এখন। তোমার ভয় করবে না?’ ‘নিজের জিনিষের উপর কেউ ডাকাতি করে এমন তো কোনদিন শুনিনি।’ রত্নাকর ‘তার মানে?’ বলতে গিয়ে থেমে জুঁইয়ের দিকে তাকালো। জুঁই অমনি মাথাটা নিচু করে নিল। রত্নাকর জুঁইয়ের মুখটা তুলে দেখার জন্যে হাতটা একটু বাড়াল। পর-মুহূর্তে সঙ্কোচে হাতটা আপনি টেনে নিল। রত্নাকর জিজ্ঞেস করতে চাইল, আমি যা শুনলাম তাই কি ঠিক। কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু বের হল, ‘তাই?’ জুঁই মাথা না-তুলে ঘাড় নেড়ে জানাল – হ্যাঁ। রত্নাকরের মনে হতে লাগল ওর মাথাটা ঠিক ঘুরছে না, তবে কেমন যেন করছে। কিছুই ভাবতে পারছে না। জুঁইয়ের ভাবভঙ্গী দেখে এর আগে যে ওর একথা মনে আসে নি তা নয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে সেসব চিন্তা নিজের কুরুচি ভেবে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। মল্লিকা সম্বন্ধেও ভেবেছিল। তারপরেই চিন্তা ভাবনাগুলো কেমন যেন গোলমালে হয়ে গিয়েছিল। ছি ছি ছি, দুই বোনকে নিয়ে এইরকম ভাবা? যারা রোজ তাদের বাড়িতে যেতে বলে। অনেকটা নিজের বাড়ির মতই হয়ে গেছে, সেখানে এইসব? জোর করে নিজের অনুমান করা অনুভূতিগুলো সরিয়ে রেখেছিল। আজ সেটাই দড়াম করে সামনে এসে পরায় নিজে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এটা কোন সমস্যা কিনা তাই বুঝতে পারছে না, যে এর কোন সমাধান বের করবে।
রত্নাকর চুপ করে আছে দেখে, জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভাবছেন? কিছু বলছেন না যে।’ ‘আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি সত্যি?’ ‘হ্যাঁ। ভেবেছিলাম, আপনি নিজেই বলবেন। কিন্তু যখন দেখলাম, আপনি এত বেশী চিন্তা করেন তাই নিজেকেই এগিয়ে আসতে হল।’ রত্নাকর উঠে গিয়ে নিজের লিমকার বোতলটা নিয়ে ঢোক ঢোক করে অনেকটা খেয়ে তারপরে চেয়ার টেনে জুঁইয়ের সামনে বসে বলল, ‘তুমি কি সবকিছু ভেবে বলছ এই কথাটা?’ ‘আপনি Love at first sight-এ বিশ্বাস করেন?’ ‘সেটা বিশ্বাস করার কথা নয়। সেটা হয়ে যায়।’ ‘এই তো, আমার ব্যাপারটা বুঝছেন তাহলে?’ ‘তার মানে?’ ‘এখন এটার মানেও আমাকে বলতে হবে? আমি চললাম তাহলে। আপনি আপনার নামটা বদলে বনেজঙ্গলে কোথাও চলে যান। ভালো মানাবে ওই পরিবেশে আপনাকে।’ এই বলে জুঁই উঠে দাঁড়াল। রত্নাকর হাত বাড়িয়ে জুঁইয়ের পথ আটকাল। বলল, ‘বসো। চললাম বললেই কি যেতে দেব ভেবেছ?’ ‘তা হলে কি আমার উপরে দস্যুবৃত্তি করবেন এখন?’ ‘নিজের জিনিসের উপরে তো সেটা করা যায় না, একটু আগেই বললে। না-হলে ভেবে দেখতাম।’ জুঁই বসে পড়ল।
জুঁই বসে তো পড়ল, কিন্তু কারুর মুখে অনেকক্ষণ কথা এলো না। জুঁই বলল, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে। কেউ যেন আপনার সব কিছু চুরি-ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আর তাই আপনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন।’ ‘তা না জুঁই। আমার না-আছে চাল, না-আছে চুলো। তুমি এতো ভালো মেয়ে। তাই ভাবছি, কি করি? তোমাকে না-বলতে মন চায় না, আবার হ্যাঁ-বলতে বুদ্ধিতে সায় দেয় না। ভাবছি, আজকের আনন্দ-খুশীটা কালকে দুঃখের কারণ হবে না তো।’ ‘এখন না আপনাকে একটু বাল্মীকি-বাল্মীকি মনে হচ্ছে।’ ‘ঠিকই বলেছো। কালকের কথা ভেবে আজটা নষ্ট করি কেন? কি করে সেলিব্রেট করি বলতো?’ ‘আগে লিমকাটা শেষ করেন তারপরে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। তাহলেই হবে। অনেকক্ষণ হল এসেছি।’
রত্নাকর জামা-প্যান্ট পরে নিল। তারপর জুঁইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘চলো।’ জুঁই রত্নাকরের হাত ধরে বিছানা থেকে উঠল। জামাকাপড়টা ঝেড়ে, তারপর চুল টেনে ঠিক করে রত্নাকরের একদম কাছে এসে বলল, ‘চলুন।’ দুজনে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে জুঁইয়ের বাড়ির মোড় অবধি জুঁইকে পৌঁছে দিল।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25