Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। আট ।।

বাড়ি ফিরে জুঁই একটা ফুরফুরে মেজাজে সাজগোজ ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে বিছানায় চলে গেল। শুয়ে প্রথমেই শম্পার কথা মনে হতে লাগল। ভাবল, কত বছর পরে ওদের দেখা হল, রত্নাকর-দা সেইটা বলল না। মনে মনে একটা হিসাব করে ভাবল, অনেক বছর হবে। এত বছর পরে দেখা হল, আর ওর জমানো টাকা দিয়ে পুরানো প্রেমিককে উদ্ধার করে আবার বেপাত্তা। ভাবতেই গা-টা কেঁপে উঠল। একটু শীত শীত করতে লাগল। চাদরটা গায়ের উপর ভাল করে টেনে পাশ ফিরে শুলো। তারপর নিজের দিদির কথা মনে হল। সঞ্জীব-দা কি না একটা বলল, আর অমনি আর কোন সম্পর্ক নেই। এদিকে আজও মনে থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। আজ সঞ্জীব-দার গানের কথায় কিরকম মুখ ভার করে ফেলেছিল। ভাগ্যিস রত্নাকর-দা সেটা বুঝতে পেরে আর কথা এগোয় নি। একবার ভাবল, রত্নাকর-দা কি দিদির সব ব্যাপার জানে? মনে মনে আবার দিদিকে ভালোবেসে ফেলে নি তো? তাহলেই কেলেঙ্কারি। লোকটা বেশ প্রাণখোলা। না-হলে এই কয়দিনেই কেমন ওদের সকলের আপন হয়ে গেছে। মাও বেশ পছন্দ করে। একবার মনে হল, রত্নাকর-দা ওর সম্পর্কে কি ভাবে? প্রথম দেখাতেই একটা নিজের লোক, নিজের লোক বলে মনে হয়। ঘুরে ফিরে রত্নাকরের আজকের কথাগুলো মনে পড়তে লাগল আর শম্পার সম্বন্ধে জুঁইয়ের ততই উৎসাহ বাড়তে লাগল। শম্পা কোথায় থাকে, তা বলল না। তবে কলকাতায় থাকে না। কারণ বলল তো, ওর এখানে কেউ নেই। আবার অ্যাকসিডেন্ট হল তো তার বাড়ির লোককে খবর দিল না কেন? চিন্তাগুলো বুড়ির সুতোর মত একবার এদিক আর একবার ওদিক উড়তে উড়তে একসময় ঘুমের মধ্যে ডুবে গেল।

অন্য ঘরে মল্লিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে মালা, দুল, চুড়ি, ঘড়ি খুলছে আর আজ অবধি রত্নাকর নিজের সম্পর্কে যা যা বলেছে, শম্পার সম্পর্কে যা বলেছে মনে করার চেষ্টা করছে। মনে পড়ল, আগে রত্নাকর বলেছিল, শম্পার বিয়ে হয় নি। আজ শম্পা কি করে জিজ্ঞেস করতেই রত্নাকর রেগে গেল। আজ বলল, কলকাতায় ওর কেউ নেই। সেদিন বলেছিল, শম্পার ফ্লাটে তালা ঝুলছে। ব্যাপারটার মধ্যে যে কিছু রহস্য আছে সেটা পরিষ্কার। ভাবতে ভাবতে ঠিক করল যে, রত্নাকর নিজে থেকে কিছু না-বললে শম্পার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। সঞ্জীবের কথা মনে হল। সঞ্জীব একদম অন্য ধরনের ছেলে। নিজের সম্পর্কে, নিজের ক্যারিয়ার সম্পর্কে ওর চিন্তা-ভাবনা একদম পরিষ্কার। আর ওই গান, কবিতা, আর শের-শায়েরী – ওটাই ওর শখ। ওর দেওয়া একটা বই এখনো টেবিলে রাখা আছে। একবার এইরকমই সেজে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি ঠিক আছে?’

সঞ্জীব ওকে টেনে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘ওকেই জিজ্ঞেস কর, তোমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে কিনা?’

প্রথমে না-বুঝতে পেরে মল্লিকা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাকে?’

‘আয়নায় দেখো।’

‘তুমি না একটা যা-তা’, বলে মল্লিকা যেই ঘুরেছে সঞ্জীব ওকে টেনে জাপটে ধরে বলল, ‘তাহলে আমার হার্ট-বিটটা শোন। তাহলেও বুঝতে পারবে।’

আর তখনি কি একটা করতে যে মা দরজার সামনে এসে হাজির। ছি-ছি, কি বিচ্ছিরি লেগেছিল।

ঘুরতে বের হয়ে মল্লিকা এই নিয়ে বলতে গেল, তো সঞ্জীব বলল, ‘মীর্জা আসাদুল্লা খান গালীবের নাম শুনেছো?’

মল্লিকা ভাবতে লাগল। সঞ্জীব বলল, ‘শোন নি। ঠিক আছে।’ তার পরের দিন ‘গালীবের শায়েরী’ বইটা এনে দিল। ভিতরে লেখা, ‘একেও জিজ্ঞেস করতে পারো, তোমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে কিনা?’

টেবিল থেকে বইটা খুলে দু-এক পাতা উল্টেপাল্টে রেখে দিল। অন্য ঘরে মা ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়েছে কি না কে জানে। ঘরের আলো সব নেভানো। জুঁইয়ের ঘরের আলোও নেভানো। শাড়ির আঁচল থেকে সেফটি-পিনটা খুলে আঁচল নামিয়ে পাশ ফিরে নিজেকে একবার দেখল। মনে পরল, একদিন সঞ্জীবের সাথে ঘুরে বাড়িতে ফিরত এসে দেখে তখন বাড়িতে কেউ নেই। সঞ্জীবকে বাইরে বসিয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে শাড়িটা বদলাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ সঞ্জীব এসে পিছন থেকে জাপটে ধরেছিল। কি যে ভয় পেয়েছিল! সেইটা মনে পরতেই মল্লিকা আঁচলটা কাঁধের উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে এসে নিজের মনে হেসে ফেলল। তারপর শাড়ি জামা বদলে হাত পা ধুয়ে শুয়ে পড়ল।

এরপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। জুঁই কলেজে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে রত্নাকর অনেক বার মল্লিকাদের বাড়িতে এসেছে। মাঝে মাঝে মল্লিকার মা ওকে রাতে খেয়ে যেতে বলেন। বলেন, ‘কি করবে এখন? হয় হাত পুড়িয়ে খাবে, নাহলে হোটেল। এখানেই খেয়ে যাও।’ প্রথম দিকে একটু বাঁধো বাঁধো লাগলেও এখন অনেকটা নিয়মের মত হয়ে গেছে। মল্লিকার বাড়িতে আসা মানে দুজনে একসাথে ফেরা। মল্লিকা বলে, ‘একটু বাড়ি হয়ে যাও।’ রত্নাকর অমনি ওর পেছন পেছন চলে আসে। প্রথম প্রথম একটু দ্বিধা-সঙ্কোচ হত। দু-তিন দিন বললে একবার আসত। এখন সেটা চলে গেছে। আগে রত্নাকর এলে মল্লিকা অফিসের জামাকাপড় বদলাতো না। এখন রত্নাকরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে বাইরের জামাকাপড় বদলে হাত-পা ধুয়ে আসে। রত্নাকর আসলেই জুঁই এসে পাশে বসে, আর কথার ফুলঝুরি চলে। যেন সব কথা ওকে না-বললে চলে না। মাঝে মাঝে রত্নাকর অস্বস্তিতে পরে যায় – এমন সব গল্প করে বসে সকলের সামনে। রত্নাকর ভাবে, কার টানে আসলে ওদের বাড়ি যায়? মল্লিকা, জুঁই, মাসিমা, না রাতের খাওয়া।

একদিন রত্নাকর ওর পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। পিছন থেকে একটা মেয়ের আওয়াজ, ‘এখানে কি করছেন?’

পিছন ঘুরে দেখে জুঁই ওকে জিজ্ঞেস করছে। ‘এই গলিতেই আমার বাড়ি। তুমি এখানে কি করতে?’

‘আমার এক বান্ধবী থাকে এইদিকে। এখানে মাঝে মাঝেই আসি। আপনাকে তো কোনদিন দেখিনি?’

‘খুব ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে আমি সারাক্ষণ এখানেই বসে থাকব। যাতে তুমি যখনই এখান দিয়ে যাবে আমাকে দেখতে পাও।’

একটা বোকা বোকা প্রশ্ন করে জুঁই নিজেই লজ্জিত তার উপরে রত্নাকরের এইরকম উত্তর। জুঁই বলল, ‘চা খওয়া হয়েছে? তাহলে চলুন।’

‘কোথায়?’

‘কেন? আপনার বাড়ীটা দেখে আসি।’

রত্নাকর পকেট থেকে পয়সা বের করে চায়ের দাম মিটিয়ে জুঁইকে বলল, ‘চলো।’

কয়েকটা বাড়ি পরেই রত্নাকর যেখানে থাকে সেই বাড়িটা। দরজার তালা খুলে রত্নাকর জুঁইকে বলল, ‘ভিতরে এসো।’

জুঁই ঘরের ভিতরে ঢুকে চারপাশ দেখতে থাকল। রত্নাকর একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসো।’

জুঁই কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি এসেছে এখানে কখনো?’

‘না।’

‘আপনি তো ঘরদোর বেশ গুছিয়ে রাখেন। আমার যেকয়টা ছেলে বন্ধুর ঘরে গেছি। কি যাতা করে সব ছড়িয়ে রাখে।’

‘আমারও তাই থাকত। শম্পা এসে সব চেঞ্জ করে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে আমিও চেষ্টা করি সেইরকম রাখতে। সবই অভ্যাসের ব্যাপার।’

হঠাৎ শম্পার প্রসঙ্গ এসে পড়ায় রত্নাকর নিজে একটু অস্বস্তিতে বোধ করল। কথা ঘোরানোর জন্যে, ‘কি খাবে বলো’, বলে উঠে দাঁড়াল।

জুঁই তাড়াতাড়ি রত্নাকরের হাতটা টেনে ধরে বসাল আর বলল, ‘আমি কিছু খাব না। আপনি বসুন তো।’

‘তোমাদের বাড়িতে আমি রোজ খেয়ে আসি। আজ বাড়ি গিয়ে বলবে, রত্নাকর-দার বাড়ি গেলাম। কিছুই খাওয়ালো না।’

জুঁই এবার চেয়ার ছেড়ে রত্নাকরের পাশে এসে বসে বলল, ‘সেটা না-হয় ডিউ থাক। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’

তারপরে হেসে বলল, ‘আর প্রমিস করছি এইরকম কিছু বলব না। আপনার সাথে একটু গল্প করি। তারপরে আমাকে উঠতে হবে আজ। অনেকক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছি।’

রত্নাকর বসে থাকল। জুঁই এসে ওর পাশে বসেছে। অনেকটা গা ঘেঁসে। চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। রত্নাকরের দিকে না-ফিরে সোজা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘আমার কয়েকটা জিনিষ জানতে খুব ইচ্ছে করছে। বলবেন?’

‘কি জানতে চাও বলো।’

‘শম্পাদি কে?’

‘সে তো তোমাকে বলেছি।’

‘আর কিছু?’

‘আর কিছু মানে?’

‘কোথায় থাকে?’

‘সেটা জানি না।’

‘আপনার সাথে যোগাযোগ নেই?’

‘না।’

‘সে কি বিবাহিত?’

‘না।’

‘থাক, আমি আসি’, বলে জুঁই সোজা উঠে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে তুলতে যাবে, রত্নাকর জুঁইয়ের হাতটা টেনে ধরল, ‘কি হল? রাগ করলে নাকি?’

‘না রাগ করব কেন? আর আমার রাগ আপনি সহ্যই বা করবেন নি বা কেন? আমারই উচিৎ হয় নি আপনার ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করা।’

রত্নাকর জুঁইয়ের কাঁধ থেকে আস্তে করে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ওকে বসালো। রত্নাকর জানে জুঁইয়ের সব ব্যাপার সোজাসুজি। মল্লিকা হলে কথা ঘুরিয়ে আরেকটু বসে তারপর একটা অজুহাত বানিয়ে উঠে যেত। জুঁই তা না। মন খুলে কথা বললে বলো, না হলে ব্যাস। ওখানেই শেষ।

রত্নাকর বলল, ‘আমি যা জানি সেটাই বলেছি।’

জুঁই এবার খাটের উপরে পা তুলে একটু পিছিয়ে গিয়ে বসে বলল, ‘আগে আপনি বসুন এখানে।’

রত্নাকর ওর সামনে বসার পরে জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনি বলেন তো এই শম্পা বলে কেউ আদৌ আছে না আপনি একটা গল্প ফেঁদে বসেছেন?’

‘সত্যি কেউ আছে। তোমার এইরকম মনে হল কেন?’

‘বাঃ। একজনের অ্যাকসিডেন্ট হল। সে আপনার বাড়িতে এসে থাকল। আপনার ঘরদোর গুছিয়ে দিল। আপনাকে টাকা দিল – সেটা না-হয় আমি ছেড়েই দিলাম। তারপরে একদিন বেপাত্তা। আর আপনি তার কোন ঠিকানা পত্র কিছুই জানেন না। তাও কে না? যে আপনার বাল্য প্রেমিকা। হয় সেরকম কেউ নেই, আপনি দরকার মত বানিয়ে বানিয়ে বলছেন, আর না-হলে বিরাট কিছু চেপে যাচ্ছেন। কোনটা ঠিক?’

রত্নাকর কিছুক্ষণ ভেবে দেখল, একবার যখন বলে ফেলেছে তখন এইরকম ভাবে রেখে দিলে ওর খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। তার উপর জুঁইয়ের আবদারের কোন বাধন নেই। আজ না-হোক কাল বলতেই হবে, বা একদিন অন্যভাবে জেনে যাবে। তার থেকে জানিয়ে দেওয়া ভাল। আরও একটুক্ষণ ভেবে বলল, ‘কিছুটা চেপেই যাচ্ছিলাম। তবে তোমার কাছে তো সে উপায় নেই। তবে শোন।’

জুঁই নড়েচড়ে একটু গুছিয়ে বসল। রত্নাকর প্রথম থেকে শুরু করল। বলল, ‘আমার থেকে তিন ক্লাস নিচে পড়ত। একই গ্রামে বাড়ি। ছোটবেলার প্রেম। প্রেম না ছাতা। কিন্তু তখন আমি ওইরকমই ভাবতাম। ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। যাহোক, একদিন এসে বলে, চলো কালকের মধ্যেই পালিয়ে বিয়ে করি। আমি ভাবলাম, পাগল নাকি? বিয়ে যদিও বা করি, নিজেই বা খাব কি আর ওকেই বা খাওয়াব কি? বাবা আমাকেই বাড়ি থেকে তাড়াবে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠালাম। যাওয়ার সময়ে বলে গেল, মামা আমার বিয়ের সম্বন্ধ করে ফেলেছে। পরে পোস্তিও না। কয়েকদিন ওর আর দেখা নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সত্যি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। দূরে কোন একটা জায়গায় বিয়ে হয়েছে শুনেছিলাম। মনে নেই আর। তারপর শম্পা আর কোনদিন গ্রামে আসে নি। তার বছর দুয়েক পরে ওর বাবা গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে কোথায় যেন চলে গেল। আর কোন খোঁজ পাই নি। আমিও ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ ওদের বিষয়ে কোন কথা বলত না। যা হয় আর কি? আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড।’

জুঁই উৎসাহে অনেকটা ঝুঁকে পরে শুনছে। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর একদিন ফ্যাক্টরি থেকে ওভার টাইম করে অনেক রাতে ফিরছি। রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। অনেক কেটে কুটে গেছে। আমি ওকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। সেদিন অতশত বুঝি নি, সেভাবে খেয়াল করে দেখিনি। তাছাড়া ওর নাম বলেছিল, সোনালি। তাই আমার মাথাতেও আসে নি। আর চেহারাও একদম বদলে গেছে। ও আমাকে চিনতে পেরেছিল। পরেরদিন যখন দেখা করতে গেলাম ও নিজের পরিচয় দিল। তারপরে বলল, ওর এখানে থাকার কোন জায়গা নেই। এদিকে সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। যাহোক আলটিমেটলি আমার এখানে এনে তুললাম।’

একটু থেমে রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, ‘এর পরে আমি যা বলব, তুমি কাউকে বলতে পারবে না। কাউকে না। প্রমিস?’

জুঁই গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমাকে ভরসা করতে পারেন।’

রত্নাকর চমকে উঠল। জুঁইয়ের মুখে এইরকম আত্মপ্রত্যয় ভাব কোনদিন দেখেনি। বলল, ‘তারপরে জানলাম, ওর মামা ওকে বিয়ে দেওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে ওকে বিক্রি করে দেয়।’

‘নিজের মামা?’

‘হ্যাঁ, নিজের মামা।’

‘লোকটাকে এখনও জেলে দিচ্ছেন না কেন?’

রত্নাকর একটু হাসল। তারপরে বলল, ‘শুনেছি সে এখন জেলেই আছে। তবে এই কাজের জন্যে না। অন্য কোন দুনম্বরী কাজ করেছিল বোধহয়।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি? যে ওকে কিনেছিল সে তো আর ওকে পটরানী করে রাখার জন্য কেনে নি। যে কারণে কিনেছিল ওকে দিয়ে তাই করিয়েছিল।’

‘ছিঃ।’

‘ছিঃ, কোনটা?’

‘আমি ভাবতে পারছি না যে নিজের মামা এইরকম করতে পারে। এর থেকে তো দেখছি রাস্তার অটো-ওয়ালাগুলো অনেক ভালো।’

‘তাহলে বুঝে দেখো, যে এসবের মধ্যে দিয়ে গেছে তার কি অবস্থা হতে পারে?’

জুঁই সরে এসে রত্নাকরের হাতটা চেপে ধরে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর অনেক পথ ঘুরে, অনেক ঘাটের জল খেয়ে, অনেক হাত বদল হয়ে এখন সে একজন এস্করট গার্ল।’

জুঁই রত্নাকরের হাতটা ছাড়ে নি। এসব শুনতে শুনতে আরেকটু কাছে টেনে নিয়েছে, অনেকটা ওর কোলের মধ্যে। কিছুক্ষণ বসে থাকল। কোন কথা নেই। রত্নাকরের হাত জুঁইয়ের গায়ের এমন জায়গায় লাগছে যে রত্নাকরের অস্বস্তি হচ্ছে। রত্নাকর আস্তে করে হাতটা টানতে চেষ্টা করল। জুঁই আরও জোরে টেনে বুকের কাছে চেপে ধরল। এবার রত্নাকর টের পেল, জুঁই কাঁদছে।

রত্নাকর হাতটা টেনে ছাড়িয়ে জুঁইয়ের পিঠের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে ধরল। জুঁই অনেকটা রত্নাকরের বুকের কাছে এসে মাথা নিচু করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কাছে এল, আর আপনি কিছু সাহায্য করলেন না? প্রেম-টেম যদি বাদও দেই, আপনার চেনা একজনের এই অবস্থা হল, আর আপনি কোন সাহায্য করলেন না?’

‘সবটা না জেনে আমাকে দোষারোপ করছ কেন? তবে কি জানো, আলটিমেটলি আমি কোন সাহায্য করি নি। সেটা একরকম ঠিকই বলেছ। ওর চলে যাওয়ার ঘটনাটা মনে পড়লে আমার নিজের উপর নিজেরই অত বিরক্তি লাগে।’

‘তারপর কি হল? চলে গেল কেন?’

রত্নাকর বলল, ‘বেশ কিছুদিন লাগল ওর সুস্থ হয়ে উঠতে। তারপরে একদিন আমার ধার-দেনার কথা জানতে পেরে আমাকে ওর একটা ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে বলল সেখান থেকে ওর কিছু জিনিষ আর টাকা নিয়ে আনতে।’

‘এই কলকাতাতেই?’

‘হ্যাঁ। এই কলকাতাতেই।’

‘আপনি যে অন্যরকম বললেন একটু আগে।’

‘শোন তো আগে পুরোটা।’

‘আচ্ছা।’

‘আমি সেখানে গিয়ে সেই টাওয়ারের গার্ডকে জিজ্ঞেস করে ওর ফ্লাটটা চিনে সেখানে গেলাম। ওর বর্ণনা মত সব পেয়েও গেলাম এবং যা যা আনতে বলেছিল নিয়ে এলাম। ও আমাকে টাকা দিল। আমি ধার শোধ করে দিলাম। তারপরে ঠিক হল আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাব। দিল্লী-পাঞ্জাব ওইসব দিকে কোথাও। বিয়ে করব।’

‘তো করলেন না কেন?’

‘সব ঠিক। চাকরীতে রিজাইন করলাম। যেদিন চলে যাব তার আগের দিন সন্ধের সময় আমি একটু বের হয়েছিলাম কিছু একটা কিনতে। ফেরার সময়ে আজ তুমি আমাকে যেখানে দেখলে, বসে চা খাচ্ছিলাম, সেখানে দেখি দুটো গাড়ি আর কয়েকজন ষণ্ডাগুণ্ডা গোছের লোক দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি এসে দেখি আরও তিনজন। শম্পাকে নিতে এসেছে। আমি তো তেড়ে গেলাম। কিন্তু শম্পা আমাকে বাধা দিল। বলল, এদের সাথে তুমি পারবে না। ওদের কাছে রিভলভার ছিল। তাও আমি অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু শম্পা আমাকে কিছুতেই কিছু করতে দিল না। বলল, কিছু করতে গেলে আমাকে মেরে ফেলতে ওদের এক সেকেন্ডও লাগবে না। পুলিশ-টুলিশ যা বলো সব ওদের হাতে। শম্পা নিজেই চলে গেল। বলল, ওর নাকি কি সব কন্ট্রাক্ট আছে ওদের সাথে। ওই গার্ডটাই নাকি ওদের এই ঠিকানার খোঁজ দিয়েছে।’

জুঁই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর আপনি আর কোন খোঁজ করেন নি?’

‘করি নি আবার? অনেকবার গেছি। সবসময় দেখি একটা তালা ঝুলছে। ভাবলাম টাকা দিয়ে যদি কোন কাজ হয়। অন্য একটা গার্ডকে টাকা দিয়ে এসেছি। কখনো যদি শম্পাকে দেখতে পায় তো আমাকে জানাবে।’

‘আমাকে একদিন নিয়ে যাবেন সেখানে?’

রত্নাকর একটু ভাবল। তারপরে বলল, ‘হয়ত না। এসবের মধ্যে পরে তোমার যদি কোন বিপদ হয়। তবে যদি কোনদিন দরকার পরে নিশ্চয়ই বলব। ফ্লাটটা শম্পার না। অন্য একজনের নামে ভাড়া নেওয়া তবে শম্পা থাকত সেখানে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিসব ভেবে জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘তবে শম্পাদি কেন আপনার সাথে যোগাযোগ করছে না?’

‘সেইটাই আমি এখনো বুঝতে পারছি না। এই প্রশ্নটাই আমার মাথা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।’

‘পুলিশে জানান নি কেন?’

‘ভেবেছিলাম সেটা। তবে এই নেটওয়ার্কের ব্যাপারে শম্পার কাছ থেকে যা শুনেছি, ভয় হয় যে তাতে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। শম্পার সাথে কথা না-বলে কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না।’

‘এত যে এনজিও আছে। যারা এদের সাহায্য করে বলে শুনি।’

‘শম্পা বলে, সব লোক দেখানো। দুয়েকটা ছুটকো-ছটকা কাজ করে। সব পুরস্কার পাওয়ার ধান্দা। এটা একটা হাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর কাগজে নাম ওঠে। টিভিতে ইন্টারভিউ দেয়। একটা সোশাল-ওয়ার্কার মার্কা সেলেব্রিটি হওয়ার ধান্দা। দেখো গিয়ে সব গুলোর পিছনে চলছে ব্যবসা। স্বামী বড় কোম্পানির বড় কর্তা। বাড়িতে বউয়ের কোন কাজকর্ম নেই। তাই এনজিও খুলে স্ট্যাটাস দেখাচ্ছে, আর নয়তো তলে তলে ব্যবসা করছে।’

‘সবাই কি তাই করে নাকি?’

‘হয়ত সবাই তা করে না। তবে এই চালে খুদ এত বেশী যে এ পেটে গেলে পেট ব্যথা করবেই।’

জুঁই চুপ করে বসে থাকল। রত্নাকর বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কি ভাবছ এখন? ভাবছ, আমি বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শম্পার কাছে শুনেছি, একবার ভেবেছিল ও নিজে গিয়ে থানায় সব জানাবে। সেই রাতেই থানার দুই বড় কর্তা ওর গেস্ট হয়ে আসে। ভাবতে পারো? তখন মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর এই এনজিও? করুক না দেখি ভিখারি পুনর্বাসন। তাতে তো আবার অনেকের রোজগার কমে যাবে। এই ভিখারির ইনকাম চেন অনেক দূর পর্যন্ত যায়। ভিখারি পুনর্বাসন করতে সত্যিকারের খাটুনি দরকার। তাদেরকে নিয়ে গিয়ে একটা থাকার জায়গা দেওয়া। তাদের চিকিৎসা। তাদের কাজ শেখানো, তাদের তৈরি জিনিষ বাজারে বিক্রি করা। তাদের মানসিক চিকিৎসা করা। স্বনির্ভরতা শেখানো। শহর থেকে দূরে যেখানে আবহাওয়া ভালো, কম খরচে জীবন চালানো যায় সেইরকম জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের পুনর্বাসন করুক তো বুঝি। তা করলে হবে না। কারণ সন্ধের পরে পার্টি, আর পেপার ওয়ালাকে ডেকে ভালো মন্দ না-খাওয়ালে তো আর আরটিকাল ছাপবে না। বলে কি না, প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে। যদি কোনদিন শম্পার কাছে বসো, ওর কাছ থেকে শুনলে তোমার চোখ উল্টে যাবে। গা বমি বমি করবে। একটু আগে এসব শুনে কাঁদছিলে। তখন আর কান্না পাবে না।’

জুঁই হঠাৎ রত্নাকরের মুখ চেপে ধরল। বলল, ‘প্লিজ, চুপ করুন। আমি আর পারছি না। আমি আপনাকে হয়ত অনেক হার্ট করে ফেলেছি। আমি আপনাকে কোন চ্যালেঞ্জ করি নি বা আপনার সততা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার। আমি যা শুনি তাই বলেছিলাম।’

রত্নাকর বুঝল ও একটু বেশী উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। জুঁইয়ের নরম হাতটা মুখের উপরে লাগাতে গায়ের মধ্যে দিয়ে একটা হালকা ঠাণ্ডা কাঁপুনি নেমে গেল। জুঁইয়ের নিশ্বাস তখন ওর গলার উপরে পড়ছে। রত্নাকর জুঁইয়ের হাতটা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি কিছু মনে করি নি। আমি কি তোমার উপর রাগ করতে পারি? আমিও তোমারই মত ভাবতাম। শম্পার কাছে একেকটা ঘটনা শুনতাম আর আমার গা রি-রি করে উঠত। তারপরে একদিন যখন আমার সামনে থেকে ওকে নিয়ে চলে গেল। উঃ! আজও ভাবলে যেমন রাগ হয়, তেমন নিজেকে অসহায় মনে হয়। তারপরে শুধু ভাবি শম্পা এখন কেমন আছে। হয়ত ভালোই আছে।’ রত্নাকর কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে রেখে একটা লম্বা শ্বাস নিল। জুঁইও তাই করল।

রত্নাকর বলল, ‘তুমি কিন্তু প্রমিস করেছো কাউকে বলবে না। এমনকি তোমার দিদিকেও না।’ একটা দম নিয়ে রত্নাকর আবার বলল, ‘এসব জানলে আমার কিছু যায় আসে না। একবার ওই গার্ডকে জিজ্ঞেস করাতে আমার যা গেছে তারপর থেকে আমি কাউকে কিছু বলি না।’

জুঁই বলল, ‘আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। ঠকবেন না। আজ উঠি। এর মধ্যে একদিন বাড়িতে আসবেন। গত সপ্তাহে একদিনও আসেন নি। আপনি যখন আপনার এত কথা বললেন, আমার একটা কথা আপনাকে বলি, আপনাকে দু-তিন না-দেখতে পেলে আমার ভীষণ বাজে লাগে।’

রত্নাকর জুঁইয়ের সাথে বাস স্ট্যান্ড অবধি গেল। ওকে বাসে তুলে দিয়ে আবার গেল চায়ের দোকানে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25