Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। সাত ।।

একটা উত্তর দিতে পেরে রত্নাকরের উৎসাহ বেড়ে গেল। বুঝল, গানগুলো তো ওরও জানা। শুধু সময়মত মনে করতে পারাটাই হল এর আসল মজা। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটা একটা করে গান মনে করতে লাগল আর ভাবল এটা কোথায় বলা যেতে পারে।

রাস্তা ফাঁকা। বাস তাই হুহু করে চলছে। রতন মনে মনে গান আউরাতে আউরাতে কখন যে সারা রাস্তা পার হয়ে গেল টের পেল না। বাড়িতে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ল।

পরের দিন অফিসে রত্নাকর মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘জুঁই কি বাড়িতে সারাক্ষণ সব কিছু গান দিয়ে উত্তর দেয়?’ মল্লিকা বলল, ‘সারাক্ষণ না-হলেও অনেকটাই তাই। যখন ওর মন ভালো থাকে আর কাউকে যদি ও সেগুলোর উপযুক্ত বলে মনে করে।’ রত্নাকর বলল, ‘আমি কি তাহলে হিটে পাশ করে গেছি ওর কাছে বলতে চাও?’ মল্লিকা বড় বড় চোখ করে তাকাল রত্নাকরের দিকে।

রত্নাকর বলল, ‘এই কয়দিন জুঁইয়ের সাথে কথা বলে, আমারও বেশ একটা নেশা হয়ে গেছে এই নিয়ে। কি করে তোমার উপরে এটা কোন প্রভাব ফেলে নি সেটাই ভাবছি।’

মল্লিকা বলল, ‘ভেবে যেদিন উদ্ধার করতে পারবে, সেদিন আমাকে জানিয়ে দিও। আমার এখন অনেক কাজ আছে, আমাকে কাজ করতে দাও। আর ওসব যদি করতে হয়, তবে যাও জুঁইয়ের কাছে।’

আজকাল অফিসে রত্নাকর মাঝে মাঝেই গান করে উঠছে। একদিন বিমলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার বলতো রত্নাকর? তোমাকে আজকাল একটু বেশী খুশী খুশী দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে একা একা গান করছ। কিছু সু-খবর আছে নাকি?’ অফিসে এই সু-খবরের অন্বেষণ একেকজনের কাছে একেক রকমের। কারুর কাছে সেটা বোনাসের পরিমাণ, কারুর কাছে প্রোমোশন, কারুর কাছে প্রেমের গল্প, আবার কারুর কাছে অন্যের কেচ্ছা-কাহিনী। রত্নাকর কোন উত্তর দিল না।

আরেকদিন রত্নাকর মাথা গুঁজে কিসব লিখে যাচ্ছে আর গুন গুন করে গান করছে। মল্লিকা কিছু একটা বলতে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু রত্নাকরের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। মল্লিকা নজর করে দেখল সেটা অনেকেরই চোখে পড়েছে। মল্লিকা একটু বিরক্তির সাথে বলল, ‘এবার গানটা থামাও। এটা অফিস। সবাই বিরক্ত হচ্ছে।’ মল্লিকার আওয়াজ পেয়ে রত্নাকর মুখ তুলেই বলল, ‘তা বলে কি প্রেম দেব না, যদি মারে কলসির কানা।’ ‘উফঃ’, বলে মল্লিকা ঘুরে চলে গেল। রত্নাকর এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই ওকে দেখছে, আর মল্লিকা গট গট করে হেঁটে নিজের টেবিলে গিয়ে বসল। রত্নাকর বুঝল, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। তারপর থেকে রত্নাকর অফিসে গান করা বন্ধ করে দিল। পরেরদিন কনিকাদি এসে বললেন, ‘কি রত্নাকর, শ্যামের বাঁশি যে আর শুনিনে। এখনো বুঝি রাধার মান ভঞ্জন হয় নি?’ রত্নাকর কোন উত্তর দিল না। শুধু আড়চোখে দেখল মল্লিকা কথাটা শুনছে এবং ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হওয়াতে রত্নাকর মুখ নিচু করে নিজের ফাইল নিয়ে এটা সেটা করতে থাকল।

সেদিন রবিবার। সকাল থেকে দুই বোনের সাজাগোজের পরিপাটি চলেছে। এদিকে জুঁইকে চমক দেওয়ার জন্যে রত্নাকর মনে মনে অনেক গানের কথা ভেবে যাচ্ছে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া আজ একটু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলেছে। বেলা তিনটে নাগাদ রত্নাকর এলো মল্লিকাদের বাড়িতে। রত্নাকর দরজার বেল টিপতেই মল্লিকার মা দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকে রত্নাকর সোফায় বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে জুঁই একেবারে টিপটপ করে সেজে বেরিয়ে এলো। দেখে রত্নাকরের কোন গান মনে এলো না। বলল, ‘বাঃ, দারুণ লাগছে। তোমাকে আজ অবধি এইরকম ভাবে সাজতে দেখি নি তো।’ জুঁই বলল, ‘বাড়িতে সন্ধে বেলায় কে আবার সেজেগুজে বসে থাকে? তাছাড়া, জানেনই তো ফার্স্ট ইম্প্রেশনটা খুব ইম্পরট্যান্ট।’ রত্নাকরের ভ্রু-দুটো একটু কুঁচকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কি আজ প্রথম দেখছি নাকি?’ ‘তা না, তবে আজ আপনার সাথে প্রথম ঘুরতে বের হচ্ছি – সেটা কি ভুলে গেলেন?’ বলতে বলতেই মল্লিকা বের হয়ে এল। রত্নাকরের মনে হল, এতক্ষণ সমুদ্রে এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার যেন একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ল। এখন সেই স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে সেই জলে নাকানি-চুবানি খাওয়া ছাড়া বাকি সবকিছুই সেখানে বেমানান। তাই কোন কিছুর তোয়াক্কা না-করে মল্লিকার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে থাকল। রত্নাকরের মনে হল, দুই বোন যেন পাল্লা দিয়ে সেজেছে। রত্নাকর মল্লিকাকে বলল, ‘আমি জুঁই ফুল দেখেছি। কোনদিন মল্লিকা ফুল দেখি নি। সেটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হয়।’ মল্লিকা ‘যাঃ’, বলে এক ঝলক চাউনি রত্নাকরের চোখের উপর দিয়ে বুলিয়ে ঘাড় লম্বা করে অন্য দিকে মুখ ফেরাল। কিন্তু ততক্ষণে হাসির ঢেউটা তার গালের শেষ প্রান্ত অবধি এসে গেছে। সেটা রত্নাকরের চোখ এড়ালো না। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। মল্লিকা ঘুরে বলল, ‘এখনো বসে আছো? যাবে না?’ রত্নাকরের মনে হল, একে তো আমি রোজই দেখি; একই মেয়ে; তবে আজ কেন এইরকম মনে হচ্ছে? একি শুধু সাজের গুনে নাকি আমি এতদিন চোখ বুজে ছিলাম। চোখে সূর্যের আলো পরে সকালের ঘুম ভাঙলে যেমনটা হয়। মনে হয়, দিনের আলোটা কি সত্যি এতো জোরালো? সারাদিন এরই মধ্যে থাকি, কখনো তো এইরকম মনে হয় না। তখন দৃশ্যত ছবির সাথে মনের মধ্যে গড়ে ওঠা ছবির যে সংঘাত হয় তাতে মনের ভিতরে থাকা ছবিটাই কেবল ভাঙ্গে। তাকে নতুন করে বানাতে সময় লাগে। রত্নাকর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, চলো’, কিন্তু সোফা ছেড়ে উঠল না। ঘোর কাটল মল্লিকার মায়ের কথায়। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা কি রাতে বাড়িতে খাবি, না বাইরে খেয়ে আসবি?’ রত্নাকর বলল, ‘আজ জুঁইকে আমার খাওয়ানোর কথা। আমরা বাইরে খেয়ে আসব।’ তারপরে পকেট থেকে দুটো গিফট বের করে একটা জুঁইকে দিয়ে বলল, ‘এটা তোমার জন্মদিনের।’ অন্যটা মল্লিকাকে দিল। বলল, ‘গুরুদক্ষিণা।’

এদিকে সিনেমা শুরু হওয়ার তখন আর বেশী দেরী ছিল না। তাই আর কথা না-বারিয়ে তিনজনে বের হল। তাড়াহুড়ো করে সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে রাস্তায় বেশী কথা হল না। সিনেমা থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেল। রত্নাকর বসল টেবিলের একদিকে আর তার উল্টোদিকে বসল জুঁই এবং মল্লিকা। রত্নাকর জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার এই গানের নেশাটা কবে থেকে হল?’ জুঁই বলল, ‘সেটা একটা মজার ব্যাপার। স্কুলে একবার অন্তাক্ষরী প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলাম। সময়মত একটাও গান মনে পড়ল না। আমার জন্যে আমাদের দল হেরে গেল। বাড়ি এসে আমার খুব মন খারাপ। তখন সঞ্জীব-দা আমাকে পড়াতে আসতেন।’ রত্নাকরের মুখ থেকে ফস করে, ‘সঞ্জীব-দা?’ বেরিয়ে এল। জুঁই বলল, ‘দিদি যদি আপনাকে কিছু বলে থাকে তাহলে আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ জুঁই মল্লিকার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘সেদিন পড়তে বসে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। সঞ্জীব-দা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? আমি সঞ্জীব-দাকে স্কুলের সব কথা বলতাম। আমি তখন চোখ-টোখ মুছে সঞ্জীব-দাকে ব্যাপারটা বললাম। সঞ্জীব-দা বললেন, পরের বছর তোমাকে অন্তাক্ষরীর চ্যাম্পিয়ন বানাবোই। সেদিন থেকে শুরু হল। আমি জানতাম না যে সঞ্জীব-দার গানের এত স্টক। যেকোন প্রসঙ্গে সঞ্জীব-দা একটা গানের লাইন বলে তারপরে আসল কথাটা বলতেন। আস্তে আস্তে আমিও কেমন করে সেটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম নিজেও জানি না।’ রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, ‘এখন নিশ্চয়ই তুমি চ্যাম্পিয়ন?’ জুঁই গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, ‘এখন? আমার ধারে-কাছে কেউ আসতে পারে না। এটা একটা নেশার মত হয়ে গেছে।’ রত্নাকর বলল, ‘জানো তো? এটা খুব ছোঁয়াচেও।’ জুঁই হি-হি করে হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘রোগটা তাহলে আপনারও ধরেছে?’ রত্নাকর গান গাইল না, শুধু বলল, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী? আমি আবাক হয়ে শুনি।’ জুঁই বলল, ‘নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে, তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে।’

শুনে রত্নাকর বুঝল, শুধু অক্ষর মিলিয়ে একটা গানের লাইন বলতে পারাটা একটা বোকাবোকা কাজ। তারসাথে মন যা বলতে চায় সেটা বলতে পারা অন্য পর্যায়ের ব্যাপার। মনে মনে নিজেকে বলল, এ কোথায় খুলেছো খাপ শিবাজী, এ হল পলাশি। আর মুখ থেকে কেবল একটা ‘হু’ আওয়াজ বের হয়ে এল।

তারপরেই খেয়াল করল জুঁইয়ের সাথে কথায় কথায় এতক্ষণ মল্লিকার দিকে নজর দেয় নি। দেখল, মল্লিকা চোখটা একটু নিচের দিকে, গম্ভীর হয়ে বসে আছে। ভাবল, এই গানের সাথে সঞ্জীবের প্রসঙ্গটা এমনভাবে জড়িয়ে আছে; হয়ত সেটা ওর ভালো লাগছে না। তার সাথে এটাও ভাবল যে জুঁই “ন”-দিয়ে এত গান থাকতে এই গানটা বেছে নেওয়াটা নেহাতই অকারণে নয়। রত্নাকরের আর ইচ্ছে করল না জুঁইয়ের গানের কোন উত্তর দিতে। ওয়েটারকে ডাক দিয়ে জুঁইকে বলল, ‘আজ তুমি অর্ডার দাও। আফটার অল এই খাওয়াটা তোমার জন্মদিনের জন্যে।’ ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেল।

রত্নাকর যদিও জুঁইকে খাবার অর্ডার দেওয়ার কথা বলল। জুঁই কিন্তু সবাইকে জিজ্ঞেস করেই ঠিক করল। এতে লাভ হল দুটো। প্রথমত কথা ঘোরানো গেল এবং দ্বিতীয়ত মল্লিকা কথা শুরু করতে পারল। মল্লিকা জুঁইয়ের মত অত কথা না-বললেও একদম চুপ করে থাকা ওর স্বভাব না। এদিকে জুঁই হঠাৎ চুপ করে যাওয়ায় রত্নাকর আর কোন কথা খুঁজে না-পেয়ে একটা অস্বস্তিতে পড়ল। এমন সময়ে রত্নাকর টের পেল টেবিলের নিচে কেউ ওর পায়ে দুইবার হালকা টোকা দিল। ও প্রথমে জুঁইয়ের দিকে তাকালো। জুঁই চোখ সরিয়ে নিল। মল্লিকার দিকে তাকালো। মনে হল, মল্লিকা যেন একটা হালকা হাসি দিল। রত্নাকরের দিকে চোখ রেখেই টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা টেনে নিয়ে এক ঢোক জল খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। রত্নাকর কিছু বুঝতে না-পেরে দুটো হাতের তালু জড়ো করে থুতনির নিচে এনে মাথার ভড়টা তার উপরে রেখে মল্লিকার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল ইশারাটা পরিষ্কার করে বোঝার জন্যে। কিছুক্ষণ পরে একপায়ের উপরে অন্য পা চড়িয়ে বসল। একটু খানি পরে সেটা নামিয়ে যেমন বসেছিল সেইরকমভাবে বসল। মাঝে দুবার জুঁইয়ের দিকে তাকালো। কেউ কিছু বলল না। রত্নাকর মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলছো না যে?’ ‘তোমাদের গানের পর্ব শেষ হলে তবে না বলব।’ গানের প্রসঙ্গটা কি কারণে মল্লিকাকে অস্বস্তিতে ফেলে সেটা বুঝে রত্নাকর এই বিষয়ে কোন কথা বলল না। চুপ করে গেল। জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল। জুঁইও মাথা নামিয়ে নিল।

মল্লিকা রত্নাকরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কবে থেকে এই কম্পানিতে কাজ করছো? শুনেছি অনেকদিন ধরে ফ্যাক্টরীতে ছিলে।’ রত্নাকরের মনে হল, মল্লিকা ওকে খেলার মাঠ থেকে একটানে বাইরে এনে বসিয়ে দিল। রত্নাকর বলল, ‘অনেক বছর হয়ে গেল। শুনেছো নিশ্চয়ই বেশ কয়েক বছর আগে একবার ফ্যাক্টরীতে বেশ অনেক গণ্ডগোল হয়েছিল। সেসব না-মেটাতে পেরে মালিকেরা তখন পুরানো কম্পানি বন্ধ করে পুরানো লোকদের ছাড়িয়ে নতুন কম্পানি করে অনেক নতুন লোক নিয়েছিল। সেই সময়ে একজন আমাকে এখানে চাকরীতে ঢুকিয়ে দেয়।’ মাঠ থেকে বের হয়ে গিয়ে বেশী ছটপট করা ভালো দেখায় না। তাই এইটুকু বলে রত্নাকর চুপ করে গেল। একবার মনে হল, এই গানটা নিয়ে ও বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। মনের ভাব ঢাকতে একটা মৃদু হাসির মত সহজ মুখোশ আর হয় না, আর তার কোন বাজে সাইড এফেক্ট নেই। শুধু দৃষ্টিটা ঠিক জায়গায় দরে রাখতে হবে। রত্নাকর গালদুটো পরিমাণ মত মুখের দুপাশে টেনে একটা হাসি-হাসি ভাব এনে মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থাকল। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটা বেশী ভালো লাগে তোমার?’ ‘ফ্যাক্টরিতে ওভার-টাইম আছে। এখানে সেটা নেই। এখানে পলিটিক্স বেশী, ওখানে সেটা কম। চাকরীতে উন্নতি করার সুযোগ ওখানকার থেকে এখানে বেশী। তাই সব মিলিয়ে এটাই ভাল বলব।’ এই বলে ভাবল, পরিবেশ হালকা করার এইটাই হয়ত একটা সুযোগ। একটু থেমেই আবার বলল, ‘তাছাড়া এখানে তুমি আছ।’ ‘হুঃ, কত যে আমার জন্য আছো এখানে?’ রত্নাকর দেখল, জুঁই মাথা ঘুরিয়ে একবার মল্লিকাকে দেখল, তারপরে রত্নাকরের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কাল কোন ভালো অফার পেলে এটা ছেড়ে চলে যাবে না?’

রত্নাকরের মনে হল, কয়েকমাস আগে এটা নিয়ে ও ভাববার মত অবস্থায় ছিল না। প্রতিমাসে গুনত বাকি টাকা শোধ করতে আর কত দিন লাগবে। শম্পার জন্যে রাতারাতি সব বদলে গেল। এতকিছু হল। এখন দুজন সুন্দরী মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে। লোকে যাকে কেতা করে বলে ডিনার করা। তাও করতে পারছে। অথচ। চিন্তার রেশটা কেটে গেল মল্লিকার কথায়। জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল? হঠাৎ করে গুম মেরে গেলে কেন? সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলতে আটকাচ্ছে। তাই তো?’ ‘না। একটা পুরানো কথা মনে পরে গেল।’ ‘কি?’ ‘কয়েকমাস আগে অবধি আমার অনেক টাকা ধার ছিল। আমি যাতে টাকা শোধ না-দিয়ে পালাতে না-পারি, তাই আমার চাকরীটা একরকম জামিন হিসাবে বন্ধক রাখা ছিল।’

মল্লিকা আর জুঁই দুজনেই একসাথে ‘কি!’ বলে চেয়ারে একটু পিছন হেলে বসল। একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’ ‘তারপর আর কি? একদিন একজন দয়া পরবশ হয়ে আমার সব ধার আমার হয়ে শোধ করে দিল। ঐ যে বললে না, কোন ভালো অফার পেলে এই চাকরীটা ছেড়ে চলে যাব কি না। তাই ভাবছিলাম। কত কি হয়? কয়েকদিন আগে এর উত্তরটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল। আর আজ, এর উত্তর জানি না। ভাবি নি। ভাল অফার পেলে ভেবে দেখব – এটুকুই বলতে পারি।’

মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, টাকার পরিমাণটা নেহাত কম ছিল না। সেদিন বললে, তোমার কেউ নেই। তুমি একা থাকো। আত্মীয়-সজ্জন কারুর সাথে যোগাযোগ নেই। তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই।’ ‘এর একটাও মিথ্যে কথা না।’ ‘ওঃ, তো এখন কি বন্ধক রাখলে?’ ‘কিছু না। যে দিয়েছে সে টাকা নিতেও চায় না।’ ‘তুমি আজ সারাক্ষণ আমাদের সাথে ছিলে। মদ-গাঁজাও কিছু খাও নি যে ভাবব উল্টোপাল্টা বকছো। তুমি বলতে চাও, একজন তোমার কাছে এল আর বলল, এই নাও টাকা আর যাও ধার শোধ করে দিয়ে এসো। আমাকে কিছু ফেরত দিতে হবে না। এটা সিনেমার গল্পেও চলবে না।’

রত্নাকর কিছু উত্তর দিল না। রত্নাকর লক্ষ্য করল, জুঁই কিছু বলছেও না, কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। উত্তেজনাটা পরে যাচ্ছে দেখে মল্লিকা বলল, ‘দিদিমা-ঠাকুমাদের কাছে শোনা যেত যে তাদের দিদিমা-ঠাকুমাদের আমলে হত যে মা-লক্ষ্মী স্বপ্নে দেখা দিয়ে এক হাঁড়ি টাকা-মোহর দিয়ে গেল।’ রত্নাকর প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে বলল, ‘অনেকটা সেরকমই।’ ‘মানে? কে দিল? সরি, টু মাচ পার্সোনাল প্রশ্ন করলাম।’ ‘না না। শম্পার কথা বলেছিলাম তোমাকে সেদিন। শম্পা দিয়েছে।’ ‘সেদিন বললে, তুমি তার কোন খোঁজ পাচ্ছ না।’ ‘এখনো পাই নি।’ ‘শম্পা কি করে?’

রত্নাকর বলল, ‘আমার বিষয়ে কাকে কি বলব, না-বলব সে স্বাধীনতা আমার আছে এবং আমি নিজেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। অন্যের বিষয়ে কতটা জানি বা তার কতটা আরেকজনকে বলব সেটা তার কাছ থেকে না-জেনে কিছু বলা আমার রুচিতে বাঁধে।’

এমন সময়ে ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। সবাই নিজের নিজের প্লেট, চামচ টেনে খাবার নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মল্লিকা সবাইকে একটু একটু করে দিয়ে নিজে কিছুটা নিয়ে খেতে শুরু করল। কেউ কোন কথা বলছে না দেখে রত্নাকর বলল, ‘কিছু মনে করো না। অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমার বিষয়ে জিজ্ঞেস করো, আমি কিছু মনে করব না।’

মল্লিকা কিছু জিজ্ঞেস করল না। তবে জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পা কে?’ ‘শম্পা আমার ছোটবেলার বান্ধবী।’ ‘বাঃ। তবে আপনি যে বললেন, তার খোঁজ পাচ্ছেন না। ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন। এই রহস্য-টহস্য আমার ভালো লাগে না।’ মল্লিকা ‘তুই চুপ’, বলে একটু বিরক্ত প্রকাশ করল।

রত্নাকর বলল, ‘তোমাকে আমি খুলেই বলছি। আমি ছোটবেলায় থাকতাম ভীমপুর বলে একটা গ্রামে। সেখানেই বড় হয়েছি। সেই গ্রামে শম্পাও থাকত। বাল্য প্রেম বলতে যেরকমটা বোঝায় সেইরকম একটা সম্পর্ক ছিল ওর সাথে। তখন আমি সবে স্কুল পাশ করেছি, একদিন শুনলাম দুম করে ওর বিয়ে হয়ে গেল। তারপরে সে উধাও – গ্রাম থেকে, আমার মন থেকেও। আর কোন দিন দেখাও হয় নি, ওর সম্পর্কে কিছু শুনতেও পাই নি। কয়েকমাস আগে হঠাৎ একটা ঘটনায় ওর সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। এখানে ওর সেরকম থাকার জায়গা নেই, তাই আমার বাড়িতে কয়েকদিন ছিল। তখনই একথায়-সেকথায় আমার ব্যাপারটা জানতে পারে। আর বাকিটা তো শুনলেই।’

জুঁই বলল, ‘বড় হয়ে গেলেও ছোটবেলার প্রেমের টানটা অন্যরকম থাকে। কি বলেন, রত্নাকর-দা?’ ‘তুমি প্রেম করেছো নাকি?’ ‘না তবে শীঘ্রি করব। বড় হয়ে যাওয়ার আগেই।’ রত্নাকরের মনে হল, জুঁই ইচ্ছে করলেই মুহূর্তের মধ্যে তিন-চারটে গানের কথায় এটা বলতে পারত। যেটা ও সাধারণত করে থাকে। আর মনে হল, কথাটার মধ্যে কোথাও যেন একটা জোর ছিল। মল্লিকাও জুঁইয়ের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালো।

তারপরে খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হল। জুঁই বলল, ‘চলুন একটু হেঁটে তারপরে বাস ধরব।’ তখন শরতকালের ফুরফুরে হাওয়া বইছে। গরম একদম নেই। রাস্তায় ভিড়ও অনেক কম। এইরকম সময়ে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগে। রত্নাকর অসুবিধায় পড়ল। তিনজনে পাশাপাশি হাঁটা বেশ মুশকিল। ও যদি আগে হাঁটে ভাল দেখায় না। পিছনে একা একা হাঁটতে ভালো লাগে না। পাশাপাশি হাঁটলে দুজনের মাঝে হাঁটবে না একপাশে হাঁটবে? এক পাশে হাঁটলে, কার পাশে হাঁটবে, সেই উদ্বেগ একটু বিড়ম্বনায় ফেলল রত্নাকরকে। যাহোক কখনো জুঁই, কখনো মল্লিকার পাশে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এল। তারপরে একটা বাস ধরে ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রত্নাকর নিজের বাড়ি ফেরত গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25