Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। পাঁচ ।।

মল্লিকা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে রতনের চলে যাওয়া দেখল। ভাবল, বাঁক নেওয়ার আগে হয়ত একবার ঘুরে দেখবে। তা আর হল না। রতনের চলে যাওয়ার শব্দ একটু একটু করে মিলিয়ে গেল। মল্লিকা দরজা বন্ধ করে ঘুরে দেখে জুঁই ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মল্লিকা বলল, ‘জুঁই তুই এটা কি করলি? রত্নাকর আর কোনদিন আসবে?’ ফিক ফিক করে হেসে জুঁই বলল, ‘ওটা আমার উপরে ছেড়ে দে। না এলে আমি ধরে নিয়ে আসব।’ ‘ছিঃ, কি ভাবল? বলতো?’ ‘যা ভাবাতে চেয়েছি তাই ভেবেছে।’ ‘তোর যে কবে জ্ঞান-বুদ্ধি হবে!’ এই বলে মল্লিকা ঘরে চলে গেল জামা-কাপড় বদলাতে। জুঁই গান ধরল – ভালোবাসার আগুন জ্বেলে কেন চলে যায়? হায়। মল্লিকা চিৎকার করে বলল, ‘অনেক হয়েছে। এবার তোর গান থামাবি?’ জুঁই চুপ করল। এক মুহূর্ত। তারপরে ধরল – কোয়েলিয়া গান থামা আজ। ‘উফ:’, বলে মল্লিকা ধড়াম করে ওর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

মল্লিকার মা বললেন, ‘খাবার বাড়ছি এখন।’ মল্লিকা ভিতর থেকে উত্তর দিল, ‘মা, আমি আজ খাব না। আসার পথে রত্নাকরের সাথে খেয়ে এসেছি।’

কিছুক্ষণ পরে জামা-কাপড় বদলে মল্লিকা খওয়ার টেবিলে এসে বসল। বলল, ‘জানো, রত্নাকরের একাই থাকে। ওর বাবা-মা কেউ নেই। কতদিন আমাকে পৌঁছে দিয়েছে রাতে, কিন্তু একদিনও বাড়িতে আসতে বলি নি। আজ শুনে খুব খারাপ লাগছিল। তাই আসার পথে এক জায়গায় দুজনে খেয়ে এলাম।’

জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি তোর গরম লাগছে না একটু?’ ‘হ্যাঁ রে।’ ‘ফ্যানটা একটু জোরে করে দে না।’ মল্লিকা উঠে ফ্যানের রেগুলেটরটা এক দাগ ঘুরিয়ে জোরে করে দিয়ে যেই এসে বসল জুঁই অমনি এক ঢোঁক জল দিয়ে মুখের ভাতটা গিলে নিয়ে গান ধরল – ঠান্ডি মে পাসিনা আসে, না ভুক না পেয়াস লাগে, ইয়ার ইয়ে। ‘নাঃ, খেয়ে নি। খাওয়ার সময় গান করতে নেই।’ মল্লিকা জুঁইয়ের পিঠে একটা কিল মারার জন্য হাত তুলেছিল। কিন্তু থেমে গেল।

মল্লিকার মা বললেন, ‘আজ ওকে এখানে খেয়ে যেতে বলতে পারতিস।’ ‘পারতাম’, তারপরে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে মল্লিকা বলল, ‘যদি এটা একটু চুপ করে থাকত।’ জুঁই বলল, ‘যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর। আজ থেকে তোর সাথে আমার আড়ি।’ ‘নে না তুই আড়ি। কে না করেছে তোকে? এই নিয়ে এই মাসে কয়বার যেন হল?’ মল্লিকা উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।

পরেরদিন অফিসে রত্নাকরকে একটু একা পেয়ে মল্লিকা রত্নাকরের কাছে গিয়ে বলল, ‘কালকের জুঁইয়ের কথায় কিছু মনে কোরো না। ও ওই রকমই। ছেলেমানুষি ওর এখনো যায় নি।’ রত্নাকর বলল, ‘আমার তো ওকে দারুণ লেগেছে। ভাবছি একদিন তুমি যখন থাকবে না এমন সময় গিয়ে ওর সাথে আড্ডা মেরে আসব।’ ‘সে-ই।’ এই বলে মল্লিকা নিজের টেবিলে চলে গেল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা। অফিস প্রায় ফাঁকা। রত্নাকর একটা ফাইল নিয়ে মল্লিকার টেবিলে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ছুতোনাতা করে দুই একটা প্রশ্ন করে কিছুটা সময় কাটালো। মল্লিকা সেটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘আসল কথাটা কি? সোজাসুজি বলতে পারো।’ রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি জুঁইয়ের উপরে রাগ করে আছো?’ ‘সম্ভব হলে করতাম। কিন্তু আমার সে উপায় নেই।’ ‘ওকে তুমি খুব ভালোবাসো। না?’ মল্লিকা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। রত্নাকর সেটা বুঝে বলল, ‘ওর উপর রাগ করে থাকা যায় না।’ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রত্নাকর বলল, ‘তুমি যেন আবার – সে আমার ছোট বোন – বলে গান করে বসো না।’ মল্লিকা একটু বিরক্তির স্বরে বলল, ‘ওটা ওর স্বভাব, আমার না। গান শুনতে হয় জুঁইয়ের কাছে যাও।’ ‘সেটাই ভাবছি। যাবো। ওর গলাটা খুব মিষ্টি।’ ‘আমি এখন বের হব। তোমার কোন কাজের কথা আছে?’ এই বলে ফাইল বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রেখে ব্যাগটা টেনে উঠে দাঁড়াল। রতন নিজের কাগজ-পত্র গুটিয়ে নিজের টেবিলে পৌঁছে দেখল মল্লিকা একাই অফিস থেকে বের হয়ে গেল।

এইরকম এর আগেও হয়েছে। এমন নয় যে অফিস থেকে ওরা দুজনে রোজ একসাথে ফেরত যায়। তবে মল্লিকার আজকের আচরণটা যেন অন্য রকম মনে হল। রতনের মনে হল, মল্লিকা বাড়ির দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, অফিসে কাজের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে করতে ওর রসিকতা-বোধটা চলে গেছে। রতন চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের ও শরীরের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে ও উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে রতন অফিস থেকে বের হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25