।। তিন ।।
কাজের চাপে কয়েকদিন কিভাবে পার হয়ে গেল রতন টের পেল না। সেদিন ছুটি। ভোরবেলায় রতনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঠিক করল, আজ যেভাবেই হোক শম্পার খোঁজ করতে হবে।
পকেটে কিছু টাকা নিয়ে রতন সকাল বেলা বের হল। পাড়ার মোড়ের মাথা থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বসুন্ধরা টাওয়ারটার কাছাকাছি পৌঁছে ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দিল। ছুটির দিনের সকালে রাস্তাতে একদম ভিড় নেই। যে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে কারুর কোন তাড়া নেই। সকলেই যেন এক হালকা মেজাজে আছে। রতন একটু এগিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে সেখানে এক কাপ চা নিয়ে বসল। সেখান থেকে বসুন্ধরা টাওয়ারটা ভালোই দেখা যায়। রতন চা খেতে খেতে আশপাশ ভালো করে দেখে তারপর শম্পার ফ্ল্যাটের দিকে গেল।
প্রথমবার এখানে এসে যে দরোয়ানকে রতন দেখেছিল সে এখন নেই। ডিউটিতে এখন অন্য এক দরোয়ান আছে। সে রতনকে দেখল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। রতন লিফটে করে উঠে গেল চারতলায়। সেখানে গিয়ে দেখল আগের দুইবারের মত আজও সেখানে তালা ঝুলছে। দরজার বাইরেটা যদিও পরিষ্কার, তবে তালাটার উপরে অল্প ধুলো জমে আছে। দেখে মনে হল না যে গত কয়েকদিনে কেউ এটাকে খুলেছে।
রতন হতাশ হয়ে দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এখানে আসার আগে রতন মনে মনে অনেক কথা ভেবেছিল। একবার মনে হয়ে ছিল শম্পা হয়ত একা আছে। তারপর ভেবেছিল, তাহলে শম্পা এতদিনে ওর সাথে একবারও দেখা করে নি কেন? তারপর মনে হয়েছিল, হয়ত অন্য কেউ আছে ওর সাথে। রতন ঠিক করে এসেছিল, সেরকম হলে শম্পার কাছ থেকে একটা সময় চেয়ে নিয়ে সেখান থেকে চটপট সরে পড়বে। এই রকম আরও নানারকম কত কি ভেবেছিল। সব ভাবনার মধ্যে একটা আশা বরাবর ছিল যে, এত সকালে শম্পার সাথে একবার অন্তত দেখা হবে।
ভালো করে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে রতন দরজার হাতল এবং তালার উপরে একটা জোরে ফুঁ দিতেই সেখান থেকে বেশ কিছুটা ধুলো উড়ে রতনের চোখে এসে পড়ল। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ হওয়াতে রতন তাড়াতাড়ি লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পাশের ফ্ল্যাটে থেকে একজন মহিলা বের হলেন। রতনের সাথে চোখাচোখি হল। তবে সেই মহিলাও কিছু বললেন না। মনে মনে রতনের খুব ইচ্ছে করছিল ওনাকে জিজ্ঞেস করে যে উনি যদি শম্পাকে এখানে দেখে থাকেন। ভাবতে ভাবতে একসময় লিফট নিচে চলে এল। লিফট থেকে বের হয়ে মহিলা গার্ডকে কিসব বলতে লাগলেন আর রতন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
রতন রাস্তায় বের হয়ে এসে চারপাশে তাকাল। কাউকে দেখতে পেলনা। শেষে ফিরে গেল গার্ডের কাছে। গার্ডকে ডেকে বলল, ৪-বি ফ্ল্যাটের লোকজন কবে থেকে বাড়ি নেই? কবে আসবে কিছু জানো? গার্ড সন্দেহের চোখে রতনের দিকে দেখে উত্তর দিল, জানি না। আমাকে কিছু বলে যায় নি। রতন আবার জিজ্ঞেস করল, কবে থেকে বাড়ি নেই? গার্ডের সন্দেহ তখন কাটেনি দেখে ওকে আশ্বস্ত করতে রতন বলল, আমি কোন পুলিশ-টুলিশ না। ৪-বি ফ্ল্যাটের ম্যাডাম আমার পুরানো বান্ধবী। অনেকদিন পরে খোঁজ পেলাম। কিন্তু যেদিনই আসি দেখি দরজা তালাবন্ধ। দেখা পাচ্ছি না। ভেবেছিলাম আজ সকালে দেখা পাব, বলতে বলতে রতন একটা চোখ টিপে গার্ডের কাছে এক-পা এগিয়ে এল। গার্ড একটু থতমত খেয়ে বলল, আমাকে কিছু বলে জান নি। আপনার নাম, ফোন নম্বর লিখে রেখে জান। দেখা হলে আমি ম্যাডামকে দিয়ে বলে দেব আপনাকে ফোন করতে। রতনের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। গার্ডের হাতটা টেনে কয়েকটা টাকা গুঁজে দিয়ে রতন বলল, আমার কোন ফোন নাই, ভাই। এখানকার ফোন নম্বরটা আমাকে দাও? আমি বরং ফোন করে জেনে নেব। তারপরে ওর ডিউটি আওয়ারসটা শুনে বলল, আমি তোমাকে ফোন করব, আর ম্যাডামের সাথে যদি দেখা হয়… না থাক্, আমিই ফোন করব। এই বলে রতন সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে রতন একটা পার্কের কাছে এসে পড়ল। সেখানে কিছুক্ষণ বসে একবার ভাবল, আরেকবার গিয়ে দেখে আসে সেখানে। এতক্ষণে যদি চলে আসে। রতন ভাবল কিন্তু উঠল না, বসেই থাকল।
বেলা বাড়ল। রতন কাছাকাছি একটা হোটেলে খাবার খেয়ে আবার উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে খুব ইচ্ছা করছিল মল্লিকার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। রতন আবার ফিরে এল বসুন্ধরা টাওয়াররে ৪-বি ফ্ল্যাটের সামনে। সেখানে তখনও সেই তালা একইভাবে ঝুলছে। ওর হঠাৎ নিজেকে ভয়ঙ্কর ক্লান্ত মনে হল। সেখান থেকে বের হয়ে রতন সোজা নিজের বাড়ি চলে গেল।
বাড়িতে ঢুকে রতন গা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হতাশা ও সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমটা যখন ভাঙল তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে। রতন বিছানা ছেড়ে উঠল না। কেবল বালিশটাকে একটু ঠিকঠাক করে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল। চিন্তা একটাই। কি করে শম্পার খোঁজ পাওয়া যায়। ও এখন আদৌ সেখানে থাকে কি না, তাই জানে না। হয়ত অন্য কোথাও চলে গেছে। তাহলে ওর এটা একটা বেকার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একবার নিজের মনে প্রশ্ন করল, শম্পা কেন ওর সাথে দেখা করতে আসছে না? তাহলে কি বিপদে পড়ল? আবার কি তাহলে হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেবে? একবার মনে হল, শম্পা হয়ত ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায় না। সেক্ষেত্রেও তো ওর সাথে কথা বলে ঠিক করতে হয় যে কি করে ও অত টাকা ফেরত দেবে, কবে দেবে, ইত্যাদি। শম্পার চলে যাওয়ার ঘটনাটা এত অপ্রত্যাশিতভাবে আর হুট করে ঘটে গেল যে, ও কিছুই করতে পারল না। এর আগে শম্পার ফ্লাটে গিয়ে ওকে না-পেয়ে মাঝে মাঝে রতন নিজেকেই দোষ দিয়েছে যে, কেন ও সেদিন ওই লোকগুলোর পিছন পিছন গেল না।
ভাবনার রেশ ধরে আরও কিছুক্ষণ কাটল। তারপরে রতন বিছানা ছেড়ে উঠল। বাইরে থেকে কিছু খেয়ে সেই রাতের মত শুয়ে পরল। পরের দিন আবার অফিস।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25