Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। পঁচিশ ।।

সেদিন শুক্রবার। ভোর থেকে টিপ-টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সঞ্জীব অন্য দিনের থেকে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। কয়েকঘন্টা পরে ও মুসৌরী রওনা হবে। সকাল সাতটা নাগাদ মল্লিকা এলো সঞ্জীবদের বাড়িতে। মল্লিকা সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। মল্লিকা নীল রঙের ছাতাটা বন্ধ করে সঞ্জীবের ঘরের বাইরে রেখে সঞ্জীবের ঘরে ঢুকল। দিন কয়েক আগে সঞ্জীব নিজের জন্য একটা ছাতা কেনার সময়ে এই ছাতাটা ওর চোখে পড়েছিল। মল্লিকার নিল রঙের যেকোনো জিনিষই ভালো লাগে। তাই নিজের ছাতা কেনার সাথে সাথে এই ছাতাটাও কিনে মল্লিকাকে দিয়েছিল।

সঞ্জীব দেখল, মল্লিকা একটু ভিজে গেছে। জিজ্ঞেস করল, ‘ছাতা থাকতে ভিজলে কি করে?’

‘অটো থেকে নামার সময়ে।’

‘এই সাত সকালে বৃষ্টিটা আজ ভোগাবে দেখছি।’ অনেকটা স্বগতোক্তির মত করে সঞ্জীব বলল।

‘যাওয়ার সময় বৃষ্টি হলে সে যাত্রা শুভ হয়।’

‘শুভ হয় না অন্য কিছু হয় তা যে জানে সে জানে। আমার কাছে এটা বিরক্তিকর।’

অন্যদিন হলে মল্লিকা হয়ত এই নিয়ে কিছু বলত। সেদিন মল্লিকা কোন বাড়তি কথা বলল না। এসে থেকে মুখখানা ভার করে আছে।

বাড়ির সবাই তখন ব্যস্ত। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে সঞ্জীবকে বের হতে হবে। রাস্তায় ভিড় থাকতে পারে। মল্লিকা সঞ্জীবের টুকিটাকি জিনিষপত্র গুছিয়ে দিল। মল্লিকা আসার পরে সঞ্জীবের ঘরে কেউ খুব একটা এল না, তবে মাঝে মধ্যেই ঘরের সামনে দিয়ে কেউ না কেউ যাতায়াত করছিল। তারই মধ্যে এটা-সেটা গোছানোর, কোন জিনিষ এদিক থেকে ওদিকে সরিয়ে রাখার ফাঁকে ফাঁকে সঞ্জীবের হালকা ছোঁয়াগুলো মল্লিকার মধ্যে শিহরন তুলছিল। একবার জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে সারা বছর শীত থাকে। সোয়েটার নিয়েছ বেশী করে?’ এই বলে একই সুটকেস তিনবার চেক করল।

মল্লিকার মনে হচ্ছিল, ও হয়ত তখনো জাগে নি। এই সবই স্বপ্নের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েকঘন্টা পরে সঞ্জীব চলে যাবে। এরপরে কয়েকমাস দেখা হবে না। তারপরেও যে কবে দেখা হবে তার কোন পরিষ্কার ধারনা নেই। ভালো চাকরী, তবে বাকি সবই কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা।

এমন সময়ে সঞ্জীব মল্লিকাকে টেনে জাপটে ধরল। মল্লিকা একটা হালকা ঠেলা দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার জোর এতই কম যে সেই ঠেলা দেওয়ার অর্থ সঞ্জীবের বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না। মল্লিকা একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকল, কতক্ষণ ওর খেয়াল নেই। ওর মনে হল কেউ যেন ওকে ঘুম থেকে ধাক্কা দিয়ে তুলল। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরে অর্ধ-তন্দ্রায় যেমন হয়, পারিপার্শ্বিক ঘটনা সবই টের পাওয়া যায় কিন্তু কোন কিছুতেই মন জড়ায় না, মন থাকে তার নিজের ঘোড়ে। মল্লিকার তেমনই মনে হল। সঞ্জীবের বুকের ওমে আচ্ছন্ন হয়ে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে কারুর আসার পায়ের শব্দে সঞ্জীব মল্লিকাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মল্লিকার মনে হচ্ছিল, যে আসে আসুক, দেখে দেখুক; এইরকম ভাবেই আরো কিছুক্ষণ থাকি। সঞ্জীব মল্লিকার কাঁধ ধরে ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপরে নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিল।

মল্লিকা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, আর বেশী সময় নেই। বলল, ‘নাও এবার তাড়াতাড়ি করে শেষ কর। এবার দেরী হয়ে যাবে। এখন বৃষ্টিটা একটু থেমেছে।’

তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘স্নান হয়ে গেছে?’

‘এখনো বোঝ নি?’

মল্লিকা লজ্জা পেল। বলল, ‘না।’

এমন সময়ে সঞ্জীবের মা খাওয়ার জন্যে ডাক দিলেন। সঞ্জীবের পেছন পেছন মল্লিকাও গেল সেখানে। সবাই মিলে একসাথে ব্রেকফাস্ট খেয়ে সঞ্জীব রওনা দেওয়ার জন্যে জামাকাপড় পড়তে নিজের ঘরে ফিরে এলো। মল্লিকা টেবিলেই বসে থাকল। অন্যদের সাথে কথা বলতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরেই সঞ্জীব যখন জামা-প্যান্ট-জুতো পরে বের হয়ে এল, একজন গেল ট্যাক্সি ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্যাক্সি এসে হাজির হল। সঞ্জীব একটা সুটকেস পিছনে তুলে দিয়ে অন্যটা পেছনের সিটে রেখে নিজে চড়ল। তারপরে চড়ল মল্লিকা। ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতেই ড্রাইভার ট্যাক্সি স্টার্ট করে রওনা দিল।

ট্যাক্সিতে উঠে মল্লিকা সঞ্জীবের একদম গা-ঘেঁসে বসল। ট্যাক্সি কিছুটা যায় আবার থামে; রাস্তায় যথেষ্ট ভিড়। মল্লিকার ভালোই লাগল। আর কিছুক্ষণ পরেই তো সঞ্জীব চলে যাবে। আবার কতদিন পরে দেখা হবে। ওর তখন মনে হল পেটের মধ্যে কতশত কথা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু গলা অবধি আসতে আসতে সব গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মল্লিকা বলল, ‘পৌঁছেই আমাকে ফোন করো।’

‘করব।’ সঞ্জীব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে মল্লিকাকে আরও একটু টনে নিল। কিছুদূর যাওয়ার পরে রাস্তায় আর তেমন ভিড় নেই। ট্যাক্সি হু হু করে ছুটল। স্টেশনে পৌঁছে দেখে ট্রেন তখনো প্লাটফর্মে দেয় নি। ট্রেনের বগিটা কোথায় হতে পারে তার একটা আন্দাজ করে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

সকালের বৃষ্টিতে প্লাটফর্মে এখানে সেখানে জল জমে আছে আর প্রায় সর্বত্র কাদা-কাদা। এর মধ্যে এই জায়গাটাই খানিকটা পরিষ্কার। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও লোক এসে ওদের আশেপাশে দাঁড়াল। মনের এইরকম অবস্থায় এই পরিবেশে আর যাই হোক প্রেমের কথা হয় না। ভালোবাসার মানুষের উপস্থিতির অনুভূতি মনের মধ্যে যে আবেশ সৃষ্টি করে তাতে মন তখন নিজের মত করে নীরবে নিজের সাথে কথা বলে যায়।

আশেপাশের লোকজন কেউ একা এসেছে, কেউ পরিবার সহ কোথাও যাচ্ছে, কারুর সাথে বিদায় জানাতে কেউ এসেছে, অনেকটা মল্লিকার মত। সঞ্জীবের মনে হল, এই তিন শ্রেণীর যাত্রীদের দেখলে সহজেই চেনা যায়। যার সাথে কেউ নেই সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, এটা-ওটা চেক করছে, তারপরে উদাস হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। যারা সপরিবারে যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে যাত্রার উচ্ছ্বাস। আর যাদেরকে কেউ তুলে দিতে এসেছে, তাদের দেখলেই বোঝা যায় তারা পাশাপাশি থাকলেও তারা দুটো ভিন্ন জগতের মানুষ। সঞ্জীব এইটা লক্ষ্য করে মল্লিকাকে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময়ে শুনল একটা পরিচিত গলায় পাশ থেকে কেউ বলল, ‘হ্যাপি জার্নি।’

সঞ্জীব সেদিকে তাকিয়ে দেখে শম্পা ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একগোছা গোলাপ আর গিফট র‍্যাপ দিয়ে মোড়া একটা বাক্স।

সঞ্জীব বলল, ‘আপনি কি করে জানলেন আমি এই ট্রেনে যাব?’

‘জানি এটাই বড় কথা, কি করে জানলাম তা জেনে আপনার কি হবে?’

শম্পা ফুলগুলো মল্লিকাকে দিয়ে বলল, ‘এটা তুমি নিয়ে যেও। সঞ্জীব ট্রেনের মধ্যে কোথায় রাখবে?’ তারপর সঞ্জীবকে বাক্সটা দিয়ে বলল, ‘এটা আপনি রাস্তায় যেতে যেতে খাবেন।’

সঞ্জীব তখনো আশ্চর্য হয়ে শম্পার দিকে তাকিয়ে আছে এমন সময়ে ট্রেনটা একটা হুইসেল দিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে লাগল। কিছু লোক একটু প্লাটফর্মের ভিতর দিকে সরে এল। শম্পাকে দেখে মল্লিকার একটু রাগই হয়েছিল প্রথমে, তারপরে ভাবল, ভালোই হয়েছে। অন্তত একা একা ফিরতে হবে না এখান থেকে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ভিড়টা বাড়ল। মল্লিকা সঞ্জীবের আরো কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। শম্পা একটু সরে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটা এসে থামল। সঞ্জীব ওদের কাছে সুটকেস দুটো রেখে টিকিট নিয়ে ট্রেনের বগি খুঁজতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে সুটকেস দুটো নিয়ে ট্রেনের কামরায় চড়ল। সাথে গেল মল্লিকা আর শম্পা।

সুটকেস দুটো সিটের নিচে ঠিক মত রেখে তিনজনে বসল, সঞ্জীব আর মল্লিকা এক সিটে আর শম্পা ওদের মুখোমুখি। সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘এতে কি এনেছেন?’ এই বলে নিজেই র‍্যাপারটা ছিঁড়ে বাক্সটা খুলল। মিষ্টি আর ড্রাই ফ্রুট। তারপর সেটা থেকে কয়েকটা শম্পাকে দিল, খানকয়েক দিল মল্লিকাকে আর নিজে একটা মিষ্টি তুলে নিল।

ট্রেনের এই কামড়ার এই অংশটাতে তেমন কেউ এল না। তবে পাশ দিয়ে যাতায়াতের পথে অনেকেই একটু দাঁড়িয়ে দুই সুন্দরী মেয়েকে দেখে যাচ্ছিল, বিশেষ করে শম্পাকে।

ড্রাই ফ্রুটগুলো খাওয়ার পরে মল্লিকা খেয়াল করল, সঞ্জীবের কাছে কোন জল নেই। মল্লিকা বলল, ‘তোমারা কথা বল, আমি জল নিয়ে আসি।’ এই বলে সঞ্জীব কিছু বলার আগেই মল্লিকা উঠে গেল।

শম্পা বলল, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান।’

‘কেন?’

‘মল্লিকার মত একজনকে পেয়েছেন।’

সঞ্জীব এর কোন উত্তর দিল না। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল।

শম্পা বলল, ‘আর একটা কথা আছে।’

‘কি?’

‘আমি ওই নতুন বাসায় যাব না। ওই বাড়ির মালিককে সোমবার ফোন করে জানিয়ে দেব।’

সঞ্জীব চমকে উঠল, জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?’

‘না, কোন সমস্যা হয় নি। আমি জানি আমার প্রতি আপনার একটা অনুভূতি আছে। তাই আপনি যাওয়ার আগে না-জানিয়ে পারলাম না। অনেকটা সেইজন্যেই এখানে আসা। আপনি এবার আমাকে আমার ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে যান।’

‘আপনি কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি আবার…’ কথা শেষ হতে পারল না। শম্পা সঞ্জীবের মুখের উপরে হাত দিয়ে চেপে ধরল। পরের মুহূর্তেই হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ‘কথা দিয়েছিলাম আর ওসব করব না, সুতরাং ও’নিয়ে আপনি ভাববেন না।’

‘তাহলে, এখন কি করবেন? থাকবেন কোথায়?’

‘বিয়ে করে সংসার করার ইচ্ছে আমার চলে গিয়েছিল অনেকদিন আগে। হঠাৎ করে রতনদার সাথে দেখা হয়ে গিয়ে সেই ইচ্ছেটা ফিরে এসেছিল। যখন বুঝলাম সেটা হওয়ার নয়, তখন অন্য পথ বের করলাম।’

এইসময়ে মল্লিকা দুটো জলের বোতল নিয়ে ফিরত এলো। শম্পা বলল, ‘আমি মাদার টেরেসা আশ্রমে কাজ নিয়েছি।’

সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি মিশনারি নান হয়ে যাবেন নাকি?’

শম্পা হাসতে হাসতে বলল, ‘না, সেরকম কিছু হওয়ার কোন ইচ্ছে এখন পর্যন্ত নেই। তবে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না। এখন ঠিক করেছি ওখানেই থাকব, সারাদিন ওদের সাথে কাজ করব। আর হয়ত কলকাতা থেকে অন্য কোথাও চলে যাব। হয়ত দার্জিলিং-এ।’

মল্লিকা আর সঞ্জীব শম্পার দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকল। কেউই কোন কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে সঞ্জীব বলল, ‘তাহলে কি এরপরে আপনার সাথে আর দেখা হবে না? কোথায় যাবেন তার ঠিকানাটা মল্লিকাকে দিয়ে যাবেন।’

মল্লিকা ঘড়ি দেখল। বলল, ‘এবার আমাদের নেমে দাঁড়ানো উচিৎ। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।’

মল্লিকা আর শম্পা ট্রেন থেকে নেমে গেল। সঞ্জীবও এলো ওদের পিছন পিছন। ওরা যেই ট্রেন থেকে নামল, ট্রেনটাও ছেড়ে দিল। সঞ্জীব মনে মনে ভাবল, ‘ভাগ্যের উপরে না-ছেড়ে আমি আর কিবা করতে পারি এখন। ট্রেনের গতি একটু একটু করে বাড়তে থাকল। যতদূর পর্যন্ত দুজনকে দেখা গেল সঞ্জীব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে ট্রেনটা একটা বাঁক নিল, তখন ওদের আর দেখা গেল না। সঞ্জীব ট্রেনের দরজা লাগিয়ে নিজের সিটে ফিরে আসতে আসতে ভাবল, হয়ত এটাই শম্পার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত কাজ, উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু, ও কি এই চেয়েছিল?

— শেষ —

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25