Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। চব্বিশ ।।

সঞ্জীবের নানান কাজে কয়েকটা দিন কেটে গেল। সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে শম্পার কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনি সঞ্জীবের মনটা একটু ভার হয়ে যায়।

শনিবার বিকালে হাতে একটু সময় নিয়ে সঞ্জীব একাই শম্পার বাসায় গেল। শম্পাকে দেখে সঞ্জীবের মনে হল আজ যেন ওকে বেশী রকমের শান্ত দেখাচ্ছে। শম্পা সঞ্জীবকে বসতে দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আজ একা আসলেন যে? ভেবেছিলাম মল্লিকাকে নিয়ে আসবেন।’

সঞ্জীব বলল, ‘একসময়ে সেইরকমই কথা হয়েছিল। তবে এখনি ওর কি একটা কাজের জন্য ও আসতে পারল না। এদিকে বাড়িওয়ালাকে সময় দেওয়া আছে, তাই আমাকে একাই আসতে হল।’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘রত্নাকরকে দেখছি না। ও যাবে না আপনার সাথে?’

শম্পা একটু মুচকি হেসে বলল, ‘রত্নাকরেরও কোন কাজ আছে আজ। আপনার সাথে আমাকে একাই যেতে হবে। পরে ওকে নিয়ে দেখিয়ে আসব আরেকদিন।’

শম্পার এই কথাটা শুনতে শুনতে সঞ্জীব নিজের মুখটা শম্পার দিক থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। এখন আড় চোখে একবার দেখল শম্পাকে। মনে হল, শম্পার মুখে হাসিটা আর নেই, কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। কথা ঘোরানোর জন্য সঞ্জীব জিজ্ঞেস বলল, ‘এই কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। আপনার খবর নেওয়া হয় নি। কি করলেন এই কয়টাদিন?’

‘করার মত তেমন কোন কাজ তো নেই। কাজের মেয়েটাকে কয়েকদিন আগে বলেছিলাম, আমি এখান থেকে চলে যাব। তুই অন্য কোন কাজ পেলে নিয়ে নিতে পারিস। এই সপ্তাহে ও অন্য কাজ নিয়ে নিয়েছে। তাই ঘরের কাজ করে আর গল্পের বই পড়ে দিন কাটিয়ে দেই। একা একা আর কি বা করব বলুন?’

সঞ্জীব টের পেল, এরমধ্যে রত্নাকরের কোন নামোল্লেখ নেই। নজরে এল, টেবিলের উপরে কোন একটা বইয়ের মধ্যে একখানা কাগজ ঢুকিয়ে মার্ক করে রেখেছে। সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বই পড়তে ভালো লাগে?’

‘ভালো সময় কাটে, অনেককিছু জানা যায়। আমার লেখাপড়া তো আর বেশিদূর এগোতে পারে নি। এই করে যতটা আশা পূরণ করা যায়। এই আর কি?’

সঞ্জীব চুপ করে বসে কিছু একটা ভাবতে থাকল। আজ এখানে আসা থেকে পরিবেশটা থমথমে। শম্পার মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস নেই।

শম্পা বলল, ‘আমার জীবনটা অনেকটা ভাড়া খাটা ট্যাক্সির মত – সওয়ারী তুলে এদিক ওদিক দৌড়ে দৌড়ে কেটে গেল। এখন কারো অধীন নই আবার যে স্বাধীন তাও বলতে পারি কই? একবার ভেবেছিলাম, এই বুঝি ভাড়া খাটার জীবন শেষ হল।’

তারপরে একটা চাপা নিশ্বাসের শব্দ। সঞ্জীবের কান সেটাকে এড়ালো না। সঞ্জীব গম্ভীর হয়ে বসে থাকল। এইরকম কথার পরে কি কথা বলা যায় সেইটা ভাবতে লাগল। দৈনন্দিন জীবনের আর পাঁচটা সমস্যার মত কোন ব্যাপার হলে, ও নিয়ে আপনি এত ভাবছেন কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে গোছের কিছু একটা বলা যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে? – এই ভাবতে লাগল।

শম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আমি একা থাকলে বাড়িওয়ালার কোন আপত্তি হবে না তো আমাকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার?’

সঞ্জীব কিছু ভেবে ওঠার আগেই ওর মুখ থেকে বের হয়ে এল, ‘কেন রত্নাকর থাকবে না আপনার সাথে? মানে আপনারা বিয়ে করছেন না?’ কথাটা জিজ্ঞেস করেই সঞ্জীবের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, ওর নিজের মধ্যে একটা অস্বস্তি হতে লাগল। সবই জানে কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না-জানার ভান করে থাকা ছাড়া আর কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।

শম্পা বলল, ‘সত্যি কথা বললে বলতে হয়, জানি না।’

‘আপনার সাথে রত্নাকরের দেখা হয় না?’

‘হয়, তবে বুঝি যে হয়ত আর বেশী দিন হবে বলে মনে হয় না।’

‘কেন ঝগড়া হয়েছে নাকি?’

‘না তা হয় নি। সেরকম কিছু হলে অন্য কথা বুঝতাম।’

‘তাহলে?’

‘আপনি বুঝবেন কিনা জানিনা। তবু মনে হচ্ছে আপনাকে বলা যেতে পারে।’

সঞ্জীব চমকে উঠল। ভাবল, শম্পা কি সব জানে? রত্নাকর যে জুঁইয়ের সাথে মেলামেশা করছে আর জুঁই যে মল্লিকার বোন। বুকের পাঁজরের নিচের পেটের একটা অংশ কেঁপে উঠল। সঞ্জীব জামাটা একটু সামনের দিকে টেনে ঢিলে করে দিল। যতটা শান্ত ভাব বজায় রাখা যায় তার চেষ্টা করে চুপ করে বসে থাকল। কোন কথা বলল না।

শম্পা একটু কিছু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আসলে রতনদা খুব ভিতু। অনেক বছর আগেকার ঘটনা। তখন আমার বাড়িতে বিয়ের কথা চলছে। আমার মামা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। ওই লোকটাকে আমার কোনদিনও পছন্দ হত না। সবকিছুতেই ওর একটা চালিয়াতি ভাব, আর বড় বড় কথা। আমার মন বলেছিল, এর মধ্যেও কিছু একটা চাল আছে। ভাবিনি সেটা এত জঘন্য হবে। সে যাহোক, আমি রতনদাকে বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে করে নাও। দরকার পড়লে আমরা বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যাব, পালিয়ে যাব। ও আমাকে ভালবাসত ঠিকই, কিন্তু এতটা সাহস ছিল না যে, আমাকে বিয়ে করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছু করবে। তারপর আমার যা হয়েছে তা নিশ্চয় জানেন।’

সঞ্জীব সংক্ষেপে বলল, ‘কিছুটা শুনেছি মল্লিকার কাছে।’

শম্পা একটু চুপ করে থেকে বলা শুরু করল, ‘এবারেও একই ব্যাপার। এবার আর পালানো নয়। এবার সবার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। অনেক শক্ত কাজ। এটা ওর সাহসে কুলাবে না।’

সঞ্জীব এবার একটা শ্বাস নিতে পারল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল একপাল মৌমাছি ওকে তাড়া করে আসছে আর ও নিজেকে এদিকে ওদিকে টেনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শম্পার এই কথা শুনে এখন মনে হল, মৌমাছির পাল অন্যদিকে দিকে বাঁক নিয়েছে। এই মুহূর্তে কিছুটা শান্তি। এখন কেবল চুপ করে নজর রেখে যাওয়া।

শম্পা বলল, ‘বহু বছর পরে এক অদ্ভুত ঘটনায় যখন রতনদার সাথে দেখা হল। জানলাম ও বিয়ে করে নি, ওর বাবা-মাও আর বেঁচে নেই। তারপরে দেখলাম, আমার উপর টানটা একদম শেষ হয়ে যায় নি। তখন ভেবে নিয়েছিলাম, এবার আমার ভাগ্য ঘুরল বোধহয়। এখন মনে হয় আমি আমার অধিকারের চেয়ে বেশী দাবি করে বসেছি। আবার একেক সময়ে মনে হয়, এ যদি আমার অতিরিক্ত চাওয়াও হয়, যার কাছে চেয়েছি এ হয়ত তার সাধ্যের বাইরে।’

সঞ্জীব তখনো বুঝতে পারল না যে, শম্পা রত্নাকর আর জুঁইয়ের সম্পর্কের কথা জানে কি না। তবে এটুকু বুঝল যে, সে কথা জানলেও তার সাথে সঞ্জীবকে জড়াবে না। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল, এই প্রসঙ্গ এসে পড়লে ও কি বলবে। যে কারণে আজ মল্লিকাকে এখানে না-নিয়ে আসা, যাতে সম্ভাব্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে এড়ানো যায়। আর এখন মনে হতে লাগল, এই লুকোচুরি এড়িয়ে, কিছু না-জানার ভান করে কতদিন চলবে।

এই ভাবতে ভাবতে সঞ্জীবের চোখ পড়ল রাধার মূর্তির উপরে। মনে পরে গেল, শম্পার সেদিনের কথাবার্তাগুলো। সেদিনের শম্পা আর আজকের শম্পার মধ্যে কি ভীষণ পার্থক্য। আজ ও অন্য সকলের মত বাঁচতে চাইছে কিন্তু কেউ নেই ওকে সাহায্য করার। সঞ্জীব মনে মনে ঠিক করে নিল, যেভাবেই হোক ওর বাসার একটা জোগাড় করে দেবে।

দুজনেই চুপ। কেউ কিছু বলল না কিছুক্ষণ। এবার শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘চা খাবেন? চা বসাই।’

সঞ্জীবের কিছু খেতেই ইচ্ছে করছিল না, তবু পরিবেশ হালকা করার জন্য ভাবল, এই ভাল। বলল, ‘আপনি খেলে বানান, আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি।’

শম্পা একটা ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে উঠে গেল। শম্পার আচরণ দেখে সঞ্জীবের একটু বিরক্তই লাগল। কিছুক্ষণ পরে শম্পা ট্রেতে করে দু-কাপ চা নিয়ে যখন ফিরত এলো, সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ওই ভাবে হেসে উঠে গেলেন কেন?’

‘বোঝেন নি?’

‘না।’

‘এতদিন জানতাম, অন্যকে সঙ্গ দেওয়া কেবল আমারই কাজ। কেউ যে আমাকেও সঙ্গ দিতে পারে, ভাবি নি।’ তারপরে কি একটু ভেবে শম্পা বলল, ‘হাসিটা আপনার উদ্দেশ্যে ছিল না, আমার নিজের উপরে ছিল। নিজেকে বললাম, আজ যা পাচ্ছো সে তোমার বরাত ভালো, এ তুমি বারবার চেয়ে বসো না। তাহলেই দুঃখ পাবে।’

সঞ্জীব বলল, ‘প্রত্যাশা সবার মধ্যেই থাকে। এ ঝেড়ে ফেলা হয়ত সম্ভব নয়।’

সঞ্জীব লক্ষ্য করল, শম্পার মুখে যে একটা হাসি লেগেছিল, তা কেমন যেন একটা শুকনো হাসিতে বদলে গেছে।

চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে শম্পা বলল, ‘আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি, কোন প্রত্যাশা নয়।’

সঞ্জীব বলল, ‘আপনি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, এবং গরীব নন। আপনার এত চিন্তা কিসের?’

সঞ্জীব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, শম্পা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেক সময়ে দেখবেন, মন্দিরের পূজার প্রসাদ লোকে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগের মধ্যে রেখে দেয়, মুখে দেয় না। তারপরে সেটা কোন গাছের তলায় বা নদীতে ফেলে দেয়। অনেক জিনিষ আছে যাকে ভক্তিভরে মাথায় ঠেকালেও মুখে দেওয়া যায় না। অনেকে এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎটা বুঝতে পারে না। অনেক সময়ে আমিও গুলিয়ে ফেলি।’

সঞ্জীব আর কিছু বলল না। তাড়াতাড়ি চা শেষ করে বলল, ‘সময় হয়ে এলো। এখন রওনা না-দিলে সেখানে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।’

শম্পা কিছুক্ষণের চায়ের কাপ দুটো নিয়ে ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে জামাকাপড় বদলে বের হয়ে এলো। তারপর সঞ্জীবের সাথে গেল সেই ফ্ল্যাটটা দেখতে।

সেখানে সঞ্জীব শম্পাকে মল্লিকাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলে বাড়ির মালিকের সাথে আলাপ করিয়ে দিল। বাসা দেখা হল। শম্পার পছন্দও হল। এখনকার মত অত বড় বা পশ এলাকায় না-হলেও, নেহাতই খারাপ না। বাড়ির মালিক শম্পার সামনেই সঞ্জীবকে বলল, ‘আমি কিন্তু একমাত্র তোমার উপরে ভরসা করে রাজি হচ্ছি। তা নাহলে, একা একজন মেয়েকে আমি ভাড়া দিতাম না।’ সঞ্জীবও তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘এর সব দায়িত্ব আমার।’ তারপর আরো কিছু কথাবার্তা হওয়ার পরে দিনক্ষণ ঠিক করে শম্পা আর সঞ্জীব সেখান থেকে বের হল।

কিছুদূর আসার পরে সঞ্জীব বলল, ‘যাক, একটা কাজ অন্তত হল। আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, আপনার জন্য বাসা একটা জোগাড় করে দেবই। আজ এটা না-হলে আবার খুঁজতে হত।’

শম্পা বলল, ‘আপনার মত বন্ধু পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমার এত বড় একটা উপকার করলেন। বলুন, কি খাবেন?’

সঞ্জীব হেসে বলল, ‘আপনার বাসায় গেয়ে আগাম খেয়ে এসেছি।’

‘সেরকম না। আপনি আর মল্লিকা একদিন আসুন। আমরা কোন ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাব একসাথে।’

‘এ দফায় সে আর হবে না। আগামী শুক্রবারে আমাকে রওনা দিতে হবে। শনিবারে মুসৌরী পৌঁছবো। রবিবার রেস্ট। সোমবার থেকে পুরো দস্তুর ট্রেনিং শুরু।’

‘এরমধ্যে একদিন আসুন।’

‘পারলে একবার ঢুঁ মেরে যাব, তবে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার মত এত সময় হবে না এরমধ্যে।’

শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সেই তো! যাও বা একজন বন্ধু পেলাম, সেও চলে যাচ্ছে দূরে।’

‘আমার কোন উপায় নেই। থাকলে এই প্রস্তাব কখনোই ছাড়তাম না।’

এই বলেই পাশে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে শম্পাকে উঠতে বলল তারপরে নিজেও চড়ল তাতে। শম্পাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বলল, ‘চল এক কাপ চা খাওয়াও। তারপরে আমি বিদায় নেই।’

শম্পা খুবই খুশি হয়ে বলল, ‘আজ আমার সত্যি খুব ভালো দিন। আসুন।’

কিছুক্ষণের মধ্যে শম্পা চা নিয়ে এলো। চায়ের কাপটা সঞ্জীবকে দিতে দিতে বলল, ‘এই শহরে একা একটা মেয়ের পক্ষে বাসা পাওয়া যে কি সমস্যা তার যদি কোন ধারনা থাকত তাহলে বুঝতেন যে আপনি আমার কি উপকার করলেন আজ।’

সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে করবেন না তো?’

‘আগে শুনি কি প্রশ্ন। তারপরে বলব।’

‘আপনার সাথে কি রত্নাকরের আর কোন সম্পর্ক নেই?’

শম্পা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সঞ্জীবও চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট খানেক ভেবে শম্পা বলল, ‘সম্পর্ক আছে বলতে গেলে যে যে সম্বন্ধ এবং আচরণের যে গভীরতা থাকা প্রয়োজন, সেগুলো এতই কম যে সম্পর্ক আছে বলে দাবি করতে পারি না। যা আছে, তা হল পুরানো টানের একটা রেশ, আর কৃতজ্ঞতাবোধ।’

‘রত্নাকর এখানে আসে না?’

‘সপ্তাহে এক-দু দিন। খোঁজ খবর নিয়ে যায়।’

‘ও কি আপনাকে কিছু বলেছে বা আপনি কি কিছু জানতে পেরেছেন?’

‘মানে অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছে কি না?’

‘হ্যাঁ, ধরুন সেইরকমই কিছু।’

শম্পা খুব গম্ভীরভাবে বলল, ‘না। তার কারণ, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার কোন কৌতূহল নাই এবং আমি আমার নিজের অবস্থানটা খুব ভালো করে জানি।’

‘যদি আপনি জানতে পারেন যে রত্নাকর আপনারই পরিচিত কারুর সাথে প্রেম করছে, তাহলে আপনি কি করবেন?’

‘রতনদা যার সাথে প্রেম করছে বা যাকে বিয়ে করবে তাকে তো আমি চিনবই একদিন না একদিন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?’

‘এতে আপনার কিছু যায় আসে না?’

‘যেখানে আমি নেই, সেখানে আমার কি যাবে আসবে বলুন তো?’ তারপরে শেষ ঢোঁক চাটা গিলে নিয়ে বলল, ‘আমি যা বলেছি সব আমার মনের কথা। অত ইতস্তত করার কিছু নেই। যা বলার বলে ফেলুন।’

সঞ্জীব নিজের কাপ থেকে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা এগিয়ে দিল। শম্পা কাপ দুটো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। সেখান থেকে ফেরত এসে জিজ্ঞেস করল, ‘সে কে মল্লিকার বোন?’

সঞ্জীব চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি জানতেন?’

‘একদম না।’

‘তাহলে?’

‘আমার, আপনার চেনার মধ্যে মাত্র দুজন আছে। মল্লিকা আর ওর বোন। মল্লিকা আপনাকে ভালোবাসে। তাহলে বাকি থাকল, ওর বোন। কি যেন নাম ওর?’

‘জুঁই। রত্নাকর আপনাকে কিছু বলে নি?’

‘আমিই জিজ্ঞেস করি নি।’

সঞ্জীব পরিষ্কার বুঝল যে শম্পার গলা অনেকটা ভারী হয়ে গেছে। সঞ্জীব শম্পার একটু কাছে সরে এসে বলল, ‘জুঁইকে আমি ছোট থেকে দেখেছি। খুব ভালো মেয়ে। তবে রত্নাকর যা হারালো, তা অনেক বড়, অনেক বেশী।’

‘বুঝেছি, এই কারণে আজ মল্লিকা এলো না। আজ আপনি একা এলেন।’ এই বলে শম্পা সঞ্জীবের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিল। সঞ্জীব বুঝতে পারল, শম্পার শরীরটা একটু একটু কাঁপছে।

সঞ্জীব একটা হাত শম্পার কাঁধের উপরে রাখল আর অন্য হাত দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘এনিয়ে আমি আর মল্লিকাও অনেক ভেবেছি। কোন সমাধান বের করতে পারি নি। তাই ঠিক করেছিলাম, এই খবর অন্যকারুর কাছ থেকে পাওয়ার আগে আমাদের কাছ থেকেই…’ সঞ্জীব কথা শেষ করতে পারল না। শম্পা ওর মাথা ও কাঁধের উপর থেকে সঞ্জীবের হাতদুটো সরিয়ে সঞ্জীবের কোলের মধ্যে গড়িয়ে পরে গেল। সঞ্জীব টের পেল ওর কাঁধের কাছে জামাটা ভিজে গেছে। কোলের মধ্যে মাথা রেখে শম্পা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল।

সঞ্জীব চুপ করে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে শম্পা উঠে বসল। শাড়ির আঁচল টেনে আবার আগের মত সোজা হয়ে বসল।

সঞ্জীব বলল, ‘আজ চলি। রাত হয়ে গেছে। আমার অনেক কাজ আছে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25