Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। তেইশ ।।

সারা রাত মল্লিকার তেমন ভালো করে ঘুম হল না। অফিসে রত্নাকরকে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে কিনা সেই নিয়ে অনেকবার ভাবল বটে তবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। সকাল সকাল স্নান সেরে মল্লিকা একটু তাড়াতাড়ি অফিসে বের হয়ে গেল সেদিন। অফিস যাওয়ার পথে একবার সঞ্জীবের সাথে দেখা না-করলেই নয়। সঞ্জীবকে জুঁইয়ের সাথে গতকাল রাতে যা কথা হয়েছে সব কথা বলল।

সব শুনে সঞ্জীব কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না। মল্লিকার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছিল, তাই আর অপেক্ষা না-করে সেখান থেকে সোজা অফিস চলে গেল।

সারাদিন যেমন তেমন ভাবে কাটল। বিকেলের দিকে যখন অফিস অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে, মল্লিকা রত্নাকরের টেবিলের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। রত্নাকর নিজের কাজের ফাইল একটু সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে?’

প্রশ্নটা সামান্য, সম্ভাব্য উত্তরটা বিশাল। মল্লিকার মাথার মধ্যে যেসব চিন্তা ঘুরছে সেগুলো কোন প্রশ্নের উত্তর নয়। সেগুলোই প্রশ্ন, আসলে অনেকগুলো প্রশ্ন। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে সেইটে কিছুতেই মাথা খাটিয়ে বের করতে পারল না। রত্নাকরের টেবিলের কাছে আসার আগে নিজের মনে মনে অনেকবার অনেকরকম ভাবে সেগুলো নিয়ে ভেবেছে। উল্টেপাল্টে নানা রকমভাবে ভেবেছিল। এখন সময়মত সব উধাও হয়ে গেল। মল্লিকা বলল, ‘না। রোজ দেখি তুমি খুব ব্যস্ত। কয়দিন তোমার সাথে গল্প করা হয় নি। আজ কাজকর্ম তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তাই ভাবলাম দেখি তুমি কি করছ।’

রত্নাকর বলল, ‘এই টেবিলে তুমি তো অনেকদিন কাজ করেছিলে। জানোই তো, এইসময়ে কাজের কিরকম চাপ থাকে।’

‘হ্যাঁ।’ – এই সংক্ষিপ্ত উত্তরটা ছাড়া আর কিছুই মাথায় এলো না তখন, অথচ পেটের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন তখনও গুড়গুড় করছে। একটা শ্বাস নিয়ে মল্লিকা বলল, ‘কোন সাহায্য লাগলে বোলো।’

‘যখন সত্যি দরকার হবে তখন নিশ্চয়ই বলব। দেখব, তখন সাহায্য কর, না পিছন ঘুরে চলে যাও।’

মল্লিকা বুঝে পেল না রত্নাকর কোন অর্থে এই কথাটা বলল। জুঁই কি এরমধ্যেই রত্নাকরকে কালকের কথাবার্তাগুলো বলে দিয়েছে? মল্লিকা বলল, ‘আচ্ছা তবে তুমি তোমার কাজ শেষ করো। ভাবছি, এর মধ্যে একদিন শম্পার বাসায় যাব। সেদিন ঠিক ভালো করে গল্প করা হল না ওর সাথে।’

রত্নাকর পাশে সরিয়ে রাখা ফাইলগুলো নিজের দিকে টানতে টানতে বলল, ‘যেও তোমার সময় মত। এখন তো আর আমাকে নিয়ে যেতে হবে না।’ এই বলে রত্নাকর ফাইলের দিকে মাথা গুঁজল।

মল্লিকা উঠে নিজের টেবিলে চলে গেল। সেখানে গিয়ে চেয়ারটা টেনে একখানা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে ভাবতে লাগল, আরেকবার যায় রত্নাকরের কাছে। গিয়ে বলে, তোমার এইসব কাজের চেয়ে তোমার সাথে আমার অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে।

কিন্তু মূল প্রশ্নটা কি সেইটে ভাবতে গিয়ে আবার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। প্রশ্নটা কি জুঁইকে নিয়ে না শম্পাকে নিয়ে? রত্নাকর কি সত্যি জুঁইকে ভালোবাসে? ওরা কি এই ব্যাপারে সিরিয়াস? নাকি, প্রশ্নটা শম্পাকে নিয়ে? শম্পার সাথে রত্নাকর কি সম্পর্ক রাখতে চায় না? কোনটা আসল প্রশ্ন? কার কথা ভেবে ওর নিজের এত স্থৈর্যচ্যুতি হচ্ছে? অদলবদল করে এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একসময়ে বুঝল, আসল প্রশ্নটা হচ্ছে নিজেকে নিয়ে। রত্নাকর এখন যাই করুক না কেন, তাতে ওর নিজের অবস্থিতিটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। তাই রত্নাকরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

মল্লিকা তখন মনে মনে ঠিক করল, ও এই নিয়ে আর ভাববে না, এর মধ্যে আর জড়াবেও না। এই ভেবে হাতের কাগজখানা ভাঁজ করে টেবিলের উপরে রেখে ব্যাগটা নিয়ে মল্লিকা আস্তে আস্তে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। দরজার কোনা থেকে একবার আড় চোখে দেখল রত্নাকরকে। রত্নাকর তখনও মাথা নিচু করে হিসাব করে যাচ্ছে, আর কোনদিকে ওর নজর নেই।

মল্লিকা অফিস থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে দেখে সকালের কথামত সঞ্জীব ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। সঞ্জীব মল্লিকাকে দেখা মাত্র জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন? অফিসে কিছু হয় নি তো?’

‘অফিস থেকে বের হওয়ার আগে ভাবলাম রত্নাকরকে কিছু জিজ্ঞেস করি, কিন্তু ওর কাছে গিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। তারপরে অনেক ভেবে দেখলাম, ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক গে। আমি কেন এর মধ্যে পড়ি?’

‘তুমি তো এর মাঝে পড় নি, এর থেকে বের হতে চাইছ।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে চলল দুজনে। তারপর সঞ্জীব বলল, ‘এই মেয়েটা যদি তোমার বোন না-হয়ে অন্য কেউ হত তাহলে তুমি কি ভাবতে?’

মল্লিকা বলল, ‘আমি মেয়েটাকে কোন দোষ দিতাম না। রত্নাকরকেই দোষ দিতাম।’

‘এক্ষেত্রেও তাহলে তাই করো।’

এই কথা শুনে মল্লিকা একটু স্বস্তি পেল। কিছুক্ষণ দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটা পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল।

সঞ্জীব বলল, ‘একটা খবর আছে।’

‘কি?’

‘আজ চাকরীর ট্রেনিং শুরুর খবর এসেছে। হাতে মাত্র আর দশটা দিন আছে। তারপরে মুসৌরী যেতে হবে?’

‘কতদিনের ট্রেনিং পিরিয়ড?’

‘চার মাস।’

‘তারপর?’

‘তারপর যেখানে পোস্টিং হবে সেখানে যেতে হবে।’

‘এটা তো দারুণ ভালো খবর।’

‘ভালো খবর নিশ্চয়। তবে শম্পাকে বলেছিলাম একটা বাড়ি ভাড়া জোগাড় করে দেব। এরমধ্যে এইসব হয়ে গেল। এখন যে এইটা তোমার উপরে ছেড়ে দিয়ে যাব, তারও তো ভরসা পাচ্ছি না। এদিকে সত্যি যদি রত্নাকর ওকে বিয়ে না-করে তাহলে ওর পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়াও খুব মুশকিল হবে।’

মল্লিকা ‘হু’ বলে চুপ করে গেল।

সঞ্জীব বলল, ‘আসলে জুঁইয়ের সাথে রত্নাকরের সম্পর্কের জন্যেই এই কাজের দায়িত্বটা নিয়ে একটু বেশী ভাবতে হচ্ছে।’ তারপরে একটু থেমে আবার বলল, ‘আজ বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেছ। এই শনিবার বিকালে ফ্ল্যাটখানা দেখাতে নিয়ে যেতে বলেছে। তুমিও চলো।’

মল্লিকা বলল, ‘আজই রত্নাকরকে বললাম একদিন যাব শম্পার সাথে গল্প করতে।’

‘বেশ তো। রত্নাকরকে বলে একটা খবর…’ বলেই সঞ্জীব থেমে গেল।

মল্লিকাও সেইটে ভালোই বুঝতে পারল। বলল, ‘আজ চলো আমাদের বাড়িতে। মা আর জুঁই শুনলে খুব খুশি হবে।’

‘আজ না। আজ অনেক কাজ আছে। যাওয়ার আগে অনেক কিছু জোগাড় করতে হবে।’

‘সেই। শম্পার জন্যে বাসা জোগাড়টা তো তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ।’

‘এই যে বলি না, “মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে।” সেই জন্যেই সেটা একটা বড় কাজ। দুঃখ হচ্ছে যে সেটা হয়ত করে যেতে পারব না।’

মল্লিকা লজ্জায় মাথাটা নিচু করে নিল। তারপরে একটু হেলে সঞ্জীবের কাঁধের উপরে মাথা রেখে বসে থাকল।

সঞ্জীব বলল, ‘রবিবারে যাব। সেদিন বেশ অনেকক্ষণ বসে গল্প করা যাবে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25