Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। বাইশ ।।

মল্লিকা বাড়ি ফিরে দেখে জুঁই তখনো বাড়ি ফেরে নি। মায়ের কাছে জানতে পারল ও সন্ধের আগে বের হয়েছে। মল্লিকা নিজের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে যখন বাইরের ঘরে এলো জুঁই তখন এসে বাড়ি ঢুকল। মল্লিকা জুঁইকে কিছু বলল না। জুঁই চটিটা দরজার পাশে খুলে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা জুইয়ের ঘরে গেল। জুঁইয়ের কাপড় বদলানো হয়ে গেছে তখন। মল্লিকা জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গিয়েছিলি এখন?’ মল্লিকা কথাটা খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল, তবু প্রশ্নটার মধ্যে কোথাও যেন কিসের একটা ইঙ্গিত থেকেই গেল।

হয়ত জুঁই সেটার আঁচ পেয়ে উল্টে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

‘এমনি জিজ্ঞেস করছি।’

জুঁই এবার মল্লিকার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি জানতে চাইছিস সেটা পরিষ্কার করে বল।’

‘আজ সন্ধায় কোথায় গিয়েছিলি?’

‘রত্নাকরের সাথে দেখা করতে।’ জুঁই কোন রকম দ্বিধা না-করে কাটাকাটা ভাবে জবাব দিল।

‘তুই কি জানিস না যে শম্পা ফিরত এসেছে?’

‘জানি। তাতে কি হয়েছে? রত্নাকর ওই রকম মেয়ের সাথে মিশবে কেন?’

মল্লিকা আর কোন কথা বলতে পারল না। ওর মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠল মনে হল। জুঁইয়ের খাটের একদিকে বসে পড়ল।

জুঁই বলল, ‘শম্পা হয়ত ভাবতে পারে রত্নাকর ওকে বিয়ে করবে। কিন্তু ভেবে দেখতো বিয়ের পরে রত্নাকর সকলের কাছে শম্পার কি পরিচয় দেবে? তারপরে ওদের সংসার, সামাজিক পরিস্থিতি কি হবে?’

প্রশ্নটা কঠিন এবং সঙ্গত। এর জবাব দেবার দায় মল্লিকার নেই। মল্লিকা বসে বসে ভাবতে লাগল, এর মধ্যে আছে ও নিজে, নিজের বোন জুঁই, সহকর্মী রত্নাকর, আরেকজন সামান্য পরিচিতা শম্পা। এই চারজনের বিবেক, বুদ্ধি, মন, প্রবৃতি এতটাই আলাদা যে একে এক জায়গায় আনা হয়ত সম্ভব না। একবার ভাবল, জুঁইয়ের জায়গায় ও নিজে থাকলে কি করত? বিবেক বলছে, ও জুঁইকে বলে তুই সরে যা। শম্পার তাতে একটা ভালো জীবন ফিরে পাবে। এদিকে মন বলছে, সত্যি কি সেটা হবে? জুঁই যা বলল, তা সবই সত্যি। বুদ্ধি বলছে, যদি রত্নাকর শম্পা বিয়ে করে এবং ওদের ছেলেমেয়ে হলে তাদের কি অবস্থা হবে? সমাজ তাদের কি চোখে দেখবে? আজ সঞ্জীব একা শম্পার বাসায় গিয়েছিল শুনে ওর নিজের মনেই বাজে চিন্তা কি একবারও উঁকি মারে নি? ভাবনার জাল ধোঁয়ার মত পাক খেতে লাগল মনের মধ্যে আর মল্লিকা তার মধ্যে ক্রমেই ডুবে যেতে লাগল।

জুঁই ঘরের মধ্যেই নিজের কাজে মন দিল। ছাড়া জামাকাপড় ভাঁজ করে তুলে রেখে বাথরুমে চলে গেল। সেখান থেকে হাত-পা ধুয়ে যখন বের হয়ে এল মল্লিকা তখন একই জায়গায় বসে আছে। জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘আজ তুই আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’

মল্লিকা আসল কারণ চেপে গিয়ে বলল, ‘কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে জিজ্ঞেস করব। সময় পাই নি।’

জুঁই আর কোন কথা বলল না। ঘরের অন্যদিকে চলে গেল। সেখানে এটা ওটা ঠিক ঠাক করে রাখতে লাগল।

মল্লিকা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পার বিষয়ে তোর সাথে কি রত্নাকরের খলাখুলি কথা হয়েছে?’

জুঁই বলল, ‘হ্যাঁ, হয়েছে। একসময় রত্নাকর শম্পাকে ভালবাসত, কিন্ত এখন একটা দায়িত্ব পালন মাত্র। ওইরকম একজন মেয়েকে রত্নাকর কেন বিয়ে করবে তুই বলতে পারিস?’

মল্লিকা বুঝল, ও যে চিন্তা নিয়ে জুঁইয়ের ঘরে এসেছিল, এখন সে চিন্তা এখন আর তার নেই। তবু বলল, ‘সব কাজ সকলের জন্য নয়, সব কাজ সকলে পারেও না। তাই বলে তাকে নিন্দা করতে হবে সেটাও ঠিক না।’

কিন্তু মনে মনে নিজেকে প্রশ করল, এখানে কে কাকে সাহায্য করছে? শম্পার মত মেয়ে যদি সমাজে ফিরে না-আসতে পারে তাহলে, ওর নারী স্বাধীনতা নিয়ে যত আত্মদম্ভ আছে সেগুলো আসল সময়ে এসে ফাঁকা বুলির মত ঠেকছে। এদিকে এর জন্য যে প্রতিদান দিতে হবে সেরকম মানুষ কোথায়? এখন জুঁইকে চাপ দিয়ে কিছু করানো মানে তো রত্নাকরকে জোর করে শম্পাকে উদ্ধার করতে পাঠানো আর নিজেরা দূর থেকে বাহবা দিয়ে যাওয়া। অথবা, এরই কোন এক রকমফের – এছাড়া আর কিছু নয়। মনে মনে রত্নাকরের উপরে ভীষণ রাগ হল।

মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যে কথাগুলো বললি, সেগুলো কি তোর কথা না রত্নাকর বলেছে?’

জুঁই বলল, ‘তুই তো সবই জানিস। শম্পার সাথে রত্নাকরের কিভাবে দেখা হয়েছিল। তারপরে ও কিভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিল। একবছরের বেশী সময়ে কোন খবর দেয় নি পর্যন্ত। তুই কি বলতে পারবি যে ও আবার ওইরকম কিছু করবে না? এরপরেও কি ভাবিস রত্নাকর ওকে ভালোবাসে?’

মল্লিকা আর কিছু বলতে পারল না। উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। বুঝল, জুঁইয়ের কথায় যুক্তি আছে। ও নিজের অধিকার ছেড়ে দেবে না। উদারতা দেখিয়ে নিজেকে মহান দেখানোর মত কোন মনোভাব তার নেই, বরং সহজ কথা সহজ করে বলতেই ও সাচ্ছন্দ বোধ করে।

মল্লিকা বুঝল, জুঁই আর রত্নাকরের মধ্য এই নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। এইসব বক্তব্য জুঁইয়ের একার নয়। এর পিছনে রত্নাকরের বক্তব্যও আছে। এখানে একজন সরব আরেকজন আছে নিরবে। কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা আর জুঁই পাশাপাশি বসে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করল। কোন কথা হল না এই নিয়ে আর। খাওয়াদাওয়ার পরে মল্লিকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই অবস্থায় কি করা উচিৎ সেই নিয়ে ভাবতে লাগল। মল্লিকা বুঝেছে, শম্পা আর যাই হোক, নির্বোধ নয়, তবে এক্ষেত্রে কতটা অবুঝ হবে সেইটেই ভাবনার বিষয়। বুদ্ধি চলে যুক্তির সাথে, কিন্তু মন শোনে হৃদয়ের কথা। আর বিপদটা সেইখানেই। একসময় মনে হল, কৌতূহলে আর উত্তেজনায় এত তাড়াতাড়ি শম্পার সাথে আলাপ না-করলেই ভালো হত। শম্পা যখন জানতে পারবে যে ওর বোন জুঁইয়ের জন্যেই রত্নাকর ওকে বিয়ে করবে না তখন ওর সম্পর্কে কি ভাববে? এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় মল্লিকা ঘুমিয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25