।। একুশ ।।
সঞ্জীব যখন শম্পার বাসা থেকে বের হল অফিস ফেরতের ভিড়টা সবে শুরু হয়েছে। মল্লিকার অফিসের সামনে যখন পৌঁছে দেখে মল্লিকা অপেক্ষা করছে। সঞ্জীবকে দেখা মাত্র মল্লিকা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল, ‘আজ দেরী করলে কেন?’
‘সে অনেক কথা আছে। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ?’
‘কয়েক মিনিট।’
সঞ্জীব একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ‘আজ সকালে হঠাৎ করে একটা বাসা ভাড়ার খোঁজ পেলাম। আর তখনই শম্পার কথাটা মনে পরে গেল। তাই বাসাটা ধরে রাখতে বলে শম্পার বাসায় গিয়েছিলাম। ওকে খরবটা দিতে।’
‘আমার সাথে গেলে পারতে।’
‘পারতাম। হয়ত তাহলে সবটাই একবারে মিটে যেত।’
‘তার মানে?’
‘মানেটা সব বলছি। আগে চল কোথাও বসা যাক।’
মল্লিকা আর সঞ্জীব হাঁটতে লাগল। ভিড়ের ঠেলা বাঁচিয়ে কখনো পাশাপাশি কখনো একটু আগে-পিছে হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল। তারপরে রাস্তার দিকে একটা টেবিলে বসে কিছু অর্ডার দিল। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পা কি বলল?’
সঞ্জীব বলল, ‘শম্পা বাসাটা দেখতে যাবে বলল। তবে যার বাসা তাকে বলেছি ও তোমাদের চেনাজানা, মানে দূরসম্পর্কের আত্মীয়।’
শুনে মল্লিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপরে বলল, ‘এটা হয়ত না-বললেই ভালো করতে। কতটুকু আর চেনা?’
‘তোমার সাথে রত্নাকরের অনেক দিনের আলাপ। এইটুকু না-বললে কে আর একজন মেয়েকে ভাড়া দেবে? তাছাড়া ওরা তো বিয়ে করবে কিছুদিনের মধ্যে।’
মল্লিকা কিছু বলল না। টেবিলের থেকে জলের গ্লাসটা টেনে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল। এমন সময়ে সঞ্জীব রাস্তার মোড়ের দিকে দেখিয়ে মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই যে ও রত্নাকর না?’
বাস-ট্যাক্সির মাঝখান দিয়ে মল্লিকা ভালোভাবে কিছু দেখতে পেল না। তারপরে রাস্তাটা যখন একটু ফাঁকা হল, তখন দেখা গেল অন্যলোকের ভিড় জমেছে। তারা রাস্তা পার হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ তারই মধ্যে আবার দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে।
মল্লিকা বলল, ‘কই আমি তো সেরকম কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে হতে পারে ও এখান দিয়ে গেল। আমি যখন বের হলাম রত্নাকর তখনও কাজ করছিল।’
সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘রত্নাকর আজ অফিসে?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘রত্নাকর অফিসের কাজে বাইরে কোথাও যায় নি?’
‘কই? না তো! কালও অফিসে এসেছে।’ তারপরে একটু কি ভেবে মল্লিকা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘রত্নাকর অফিসের কাজে বাইরে গেছে, এ’কথা কে বলল?’
সঞ্জীব আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভালো করে সব লোকজনকে দেখে তারপরে বলল, ‘শম্পা বলল।’
‘হুঁ’ বলে মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘আর কাউকে দেখলে ওর সাথে?’
‘অনেক লোক ছিল পাশে। কেউ ওর সাথে ছিল কিনা বলতে পারব না।’
এমন সময়ে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। সঞ্জীবের সে’দিকে কোন খেয়াল নেই। মাথার মধ্যে শম্পার বলা, অফিসের কাজে ও কয়েকদিনের জন্যে বাইরে গেছে – এই কথাটা মনে পড়ছে আর তারপরে শম্পার দৃষ্টিটা চোখের সামনে ভাসছে। এদিকে মল্লিকা বলল, রত্নাকর রোজই অফিসে এসেছে। আর এইমাত্র যাকে দেখল সে যে রত্নাকর ছাড়া আর কেউ ছিল না সে বিষয়ে ও একবারে অসন্দিগ্ধ। অতএব বিষয়টার রহস্যোদ্ধার করা কোন কঠিন কাজ নয়। তবে এই গোয়েন্দাগিরি করতে হলে প্রথমেই যে ফরমুলাটাকে সামনে রাখতে হয় সেটা মানতে বেশ কষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত কে সেই মেয়ে?
মল্লিকা বলল, ‘কি ভাবছ এত?’
‘ভাবছি, শম্পা বলল রত্নাকর কয়েকদিনের জন্যে বাইরে গেছে, তুমি বললে ও অফিসে আসছে। একটু আগে যাকে দেখলাম সে রত্নাকরই ছিল। তাহলে রত্নাকর শম্পাকে মিথ্যে কথা বলল কেন?’
মল্লিকা কিছু বলল না। প্লেট টনে একটু একটু করে খেতে সুরু করল। সঞ্জীব একটা কাটলেটে কামড় দিয়ে বলল, ‘রত্নাকর কি অন্য কারুর সাথে প্রেম করছে?’
মল্লিকা বলল, ‘হতেও তো পারে। শম্পা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। কোন ফোন করা নেই, চিঠি নেই, খবর পর্যন্ত নেই। এইসময়ে রত্নাকর যদি অন্য কারুর সাথে সম্পর্ক করে থাকে তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।’
‘তাহলে ও শম্পাকে সেকথা বলে নি কেন?’
‘বলে নি সে কথা তুমি জানলে কি করে? আবার বলার কিছু অসুবিধাও থাকতে পারে। কোন ওব্লিগেশন থাকতে পারে যে কারণে হয়ত বলতে পারে নি। সময় হলে হয়ত বলে দেবে।’
সঞ্জীব নিজের প্লেটটা একটু সরিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন তুমি এর ভিতরের খবর জানো।’
মল্লিকা কিছু বলল না। প্লেটটা টেনে একটু একটু করে খেতে লাগল।
সঞ্জীবকে কিছু না-বললে যে ও বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করবে এমন ছেলে সে নয়। তবে কিছু না-জানানোটা উচিৎ হবে ভেবে মল্লিকা বলল, ‘আমার মনে হয় জুঁইয়ের সাথে রত্নাকরের প্রেম চলছে।’
শুনে সঞ্জীব আঁতকে উঠল। বলল, ‘বলো কি? আমাদের জুঁই?’
মল্লিকা মাথা কোন কথা বলল না। শুধু মাথা নেড়ে জবাব দিল, হ্যাঁ।
সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘কবে হল? তুমি জানতে? কই আমাকে বল নি তো?’
‘সে অনেক ঘটনা। রত্নাকরকে আমি প্রথম আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই। ও একা থাকে শুনে মা মাঝে মাঝে আসতে বলত। সেই থেকে ঘনিষ্টতা। এর পর কবে প্রেম হল না-হল এতসত আমি জানি না। জুইকেও জিজ্ঞেস করি নি। যেদিন জানলাম শম্পা ফিরত এসেছে, জুঁইকে বললাম সেই খবরটা, সেদিনই বুঝলাম এই ব্যাপারটা। ভেবেছিলাম, রত্নাকর শম্পার কাছে চলে যাবে। তাই এই নিয়ে কথা বাড়াই নি আর। আজ যখন জানলাম ও মিথ্যে কথা বলে শম্পাকে অ্যাভয়েড করছে, তখন মনে হচ্ছে ও জুঁইয়ের সাথে বেশী জড়িয়ে পড়েছে।’
সঞ্জীব আর কোন কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ কাটলেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তারপরে গপ করে বড় একটা অংশ খেয়ে নিয়ে প্লেটটা সরিয়ে রাখল। প্রথমে ওয়েটারকে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল, তারপরে মল্লিকাকে বলল, ‘তোমার জুঁইয়ের সাথে কথা বলে ওদের সম্পর্কটা পরিষ্কার করে জানা উচিৎ।’
মল্লিকা বলল, ‘তবে আমি রত্নাকরকে পুরোপুরি দোষ দিতে পারি না।’
‘এটা দোষের কথা নয়। এ যদি সত্যি হয় একদিন না একদিন শম্পা জানতে পারবে। সেদিন কি ভাববে আমাদের সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত তখন শম্পাই বা কি করবে?’
‘তোমার দেখছি শম্পাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা।’
সঞ্জীব হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ‘খুব না-হলেও কিছুটা তো আছেই। তোমার সাথে থেকে আমিও যে জড়িয়ে পড়েছি। এখন একটু দুশ্চিন্তা না-করে উপায় আছে?’
চা খেতে খেতে আর বেশী কোন কথা হল না। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কিছুটা হেঁটে মোড়ের ওপার থেকে ট্যাক্সি নিয়ে মল্লিকা নিজের বাড়ি চলে গেল সেই সন্ধেয়।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25