।। আঠেরো ।।
রত্নাকর আর মল্লিকা শম্পার ফ্ল্যাট থেকে বের হল। রাস্তার মোড় থেকে ট্যাক্সি ধরে মল্লিকাকে ওর বাড়িতে নামিয়ে ওই ট্যাক্সিতেই ফিরত আসবে এই বলে দুজনে ট্যাক্সিতে উঠল।
শনিবারের সন্ধ্যা রাত। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। ট্যাক্সি চলল বেশ জোরেই। ট্যাক্সিতে উঠে মল্লিকা চুপ করে বসে থাকল। অনেকটা রাস্তা যাওয়ার পরে মল্লিকা বলল, ‘শম্পার সাথে কথা বললে মনে হয় না যে ও মাত্র স্কুল পাশ।’
হঠাৎ এই কথার কোন তাৎপর্য বুঝতে না-পেরে রত্নাকর কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা আবার বলল, ‘একজন লোক আরেকজনকে কত সহজেই ভুল ভাবে বোঝে? কারুর সাথে না-মিশলে তাকে বোঝাই যায় না।’
রত্নাকর বলল, ‘হঠাৎ তুমি এমন দার্শনিকের মত কথা বলা শুরু করলে। শম্পা কি বলেছে?’
‘কিছু না। এমনিই অনেক গল্প হল। তাই বলছি।’ মল্লিকার মনে হল, ভাগ্যিস একজনের মনের কথা আরেকজন জানতে পারে না। কিরকম ধারণা নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়িতে। এখন ও’সব ভাবলে নিজেরই খারাপ লাগছে। আজ শম্পা যা বলল, সেই নিয়ে একদিন সঞ্জীবের সাথে কি তুলকালাম ঝগড়া হয়েছিল। মল্লিকার মনে পড়ল, ও সেদিন সঞ্জীবকে বলেছিল, ‘তোমার মুখে যতসব জ্ঞানগম্যির কথা আর ভিতরে ভিতরে মেয়েদের সম্পর্কে এইরকম নিচু মনোভাব।’
সঞ্জীব একটুও রাগে নি। বলেছিল, ‘তাহলে একটা ঘটনা বলি, শোন। ছোটবেলায় আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সেখানে একটু বৃষ্টি হলেই জল জমে যেত। বর্ষাকালে কোথা থেকে কিছু ইটও চলে আসত। সেগুলো পেতে কোনরকমে রাস্তা পার হলেই মনে হত, এবারের মত জিতে গেলাম। আর বাকিরা? তাদের ভাবনা তারা ভাবুক। এইভাবে চলে আসত। সেবার কোথা থেকে এক নতুন বাসিন্দা এসে পাড়ায় জুটল। সে সবাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু টাকা তুলে নর্দমার যে জায়গাটা ভেঙ্গে বড় নর্দমাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটাকে ঠিক করার পরে আর জল জমে না।’
মল্লিকা বলেছিল, ‘এটা তো কর্পোরেশনের কাজ। ওরা কেন করবে না?’
সঞ্জীব বলেছিল, ‘অন্য সবাই সেইরকমই ভেবে কেউ কোনদিন কিছু করে নি। তবে কাজটা হয়ে যাওয়ার পরে সুফলটা সবাই পেয়েছিল।’
‘সবাই টাকা দিয়েছিল?’
‘দিয়েছিল। কেউ একটু কম, কেউ একটু বেশী।’
‘এর সাথে নারী স্বাধীনতার কি আছে?’
‘আমাদের চিন্তা ভাবনা খুব সীমিত। মেয়েরা যা চায় তার কারণ এবং যৌক্তিকতা আছে। তবে যেভাবে তারা সেটা পাবে বলে ভাবে, সেইটে খুব সীমাবদ্ধ চিন্তার ফল। সামগ্রিক উন্নতির কথা ভাব।’ তারপরে একটা জোরে শ্বাস ছেড়ে বলেছিল, ‘একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। আমি আশাবাদী।’
সেদিন মল্লিকার মনে হয়েছিল, সঞ্জীব কয়েকখানা বই পড়ে খুব বাতেলা ঝাড়ছে। সামনে ছিল একটা নিউজ পেপার। রাগ করে পড়ার ভান করে সেটা টেনে নিয়ে মুখের সামনে ধরতেই মল্লিকার চোখ পড়ল একটা মাঝারি মাপের হেডলাইনে। লেখা আছে, জন্মের পরেই মেয়ে সন্তান হত্যার দায়ে ধৃত সন্তানের বাবা। মল্লিকার মনে হয়েছিল, এইতো পেয়েছি। সঞ্জীবের সামনে পেপারটা ধরে বলল, ‘পরে দেখো। এর সম্বন্ধে কি বলবে?’
সঞ্জীব খুব ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মল্লিকার হাত থেকে পেপারটা নিল। তারপরে কিছুক্ষণ মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থাকল। পেপারের দিকে তাকালো না। মল্লিকার ভীষণ রকম অস্বস্তি হতে লাগল। বলল, ‘পড়ে দেখো।’
সঞ্জীব পড়ে বলল, ‘তোমাদের পাড়ায় থাকে আগরওয়াল। তাকে চেন? তার সামনে পাড়া কেন তার বাড়ির সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে। শুধু জব্দ ওর মেয়ের কাছে। আগরওয়াল কিন্তু টাকার কুমির। ও জানে মেয়েকে বিয়ে দিতে ওর অনেক টাকা গচ্ছা যাবে। তবু ভাবে মেয়ে বাড়ির লক্ষ্মী। তাই এত প্রশ্রয় দেয়। আগরওয়াল রেগে থাকলে ওর বাড়ির লোকজন মেয়েকে এগিয়ে দেয় আর অমনি আগরওয়াল গলে জল। তোমাদের কাছেই শোনা।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সঞ্জীব বলল, ‘মূল বিষয়টা অর্থনৈতিক। অল্প কিছুটা শিক্ষা। যে লোকটা ওর সদ্যজাত শিশুকে মেরেছে সে যদি পাগল না-হয় ধরে নেই, তাহলে এটা কেবলই সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপে।’
মল্লিকা বলেছিল, ‘তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না। বলাই বৃথা।’
‘এটা বিতর্কে জেতার প্রশ্ন নয়। আমিও এক সময় তোমার মতই ভাবতাম। এক সময় বুঝলাম, লোকে আসল সমস্যাটাকে ঢেকে রাখার জন্যে জনপ্রিয় একটা ধারণা দিয়ে আসল সমস্যাটাকে আড়াল করে রাখে, মূলত রাজনৈতিক স্বার্থে। আর মজার ব্যাপার হল, সেই নিয়ে সবাই নাচে। কেউ গোঁড়া থেকে তলিয়ে দেখে না, এমন কি যাদের আমরা এই বিষয়ে অগ্রদূত বলে ভাবি।’ এই বলে মাথা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেপারটা মল্লিকাকে ফেরত দিল।
আজ শম্পার কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন সঞ্জীব ওর মুখ দিয়ে কথাগুলো বলছে। মল্লিকা ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হল।
ট্যাক্সিটা তখন প্রায় বাড়ির কাছে চলে এসেছে। মল্লিকা রত্নাকরের দিকে তাকাল। রত্নাকর সোজা হয়ে বসে আছে। অন্যসময় মল্লিকার সাথে সারাক্ষণ বকবক করত। আজ রত্নাকরও কেমন যেন চুপ করে বসে আছে। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভাবছ এত মন দিয়ে?’
‘ভাবছি, আমি কোনদিন শম্পাকে অন্য কারুর সাথে গল্প করতে দেখি নি। আজ প্রথম দেখলাম। ওর চোখেমুখে যে খুশীর ছাপ দেখলাম, এর আগে কোনদিন দেখি নি।’
‘ও খুব ভালো মেয়ে। ওর সাথে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল যেন সঞ্জীব ওকে সব শিখিয়ে দিয়েছে।’
‘আমি তো জানতাম না যে শম্পা কবিতা জানে?’
‘নারে বাবা, কবিতা না। মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে কথা হচ্ছিল।’
‘হু’। রত্নাকর একটুক্ষণ কি একটা ভেবে, তারপরে বলল, ‘ওর জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও যখন কিছু বলে, আমি তো হাঁ করে শুনি আর অবাক হয়ে যাই।’
এমন সময়ে মল্লিকার বাড়ির কাছে ট্যাক্সি চলে এলো। মল্লিকা ড্রাইভারকে ট্যাক্সি একপাশে থামাতে বলে, নেমে গেল আর বলল, ‘একদিন ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসো।’ তারপরে বলল, ‘থাক্, আমি বরং আরেকদিন যাব।’
ট্যাক্সিটাকে ঘোরাতে বলে রত্নাকর মল্লিকার হেঁটে চলে যাওয়ার দিকে দেখতে থাকল। মল্লিকা মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। মনে হল, যেন কিছু খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছে।
ট্যাক্সি ঘুরে গেল। মল্লিকাকে আর দেখা গেল না।
মল্লিকা বাড়ি পৌঁছানো মাত্র ওর মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে? আজ এত দেরী হবে বলে যাস নি তো।’
‘আজ একটু কাজ ছিল’, বলে মল্লিকা নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে মল্লিকার মনে হল, অকারণ মিথ্যা কথা বলার কোন দরকার ছিল না। রত্নাকরের সাথে কোথাও গিয়েছিল বললেও পারত। আসলে ট্যাক্সি থেকে নেমেই রাস্তার অন্যদিকে সঞ্জীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়ে সব কেমন গোল পাকিয়ে গিয়েছে। কি জন্যে যে ও দাঁড়িয়েছিল সেটা বুঝতে পারল না। হয়ত ওর সাথে কথা বলার জন্যে। তাহলে ও ডাকল না কেন? মনে হচ্ছে আজকের সব কিছু যেন সঞ্জীবের সাজানো।
কিন্তু তাই বা কি করে হয়? শম্পা, রত্নাকর কেউ তো সঞ্জীবকে চেনে না।
বাইরে থেকে মল্লিকার মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে কিছু খাবি এখন?’
মল্লিকা বলল, ‘না। বিকালে অফিসে খেয়েছি। একেবারে রাতে খাব।’
মল্লিকা উঠে জামা-কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের চেয়ারটায় এসে বসল, আর মন চলে গেল সঞ্জীবের আশেপাশে।
দরজাটা খোলা, তবে পর্দাটা অনেকটা টানা। বাইরে মা বসে টিভি দেখছে। মল্লিকার মনে হল আজ যেন টিভির ভলিয়ুমটা একটু জোরে। সঞ্জীব এলে মা এইরকম করত, যাতে ওরা ভাবে এখানকার কথা বাইরে শোনা যাচ্ছে না।
মল্লিকার মনে পড়ল, সেদিন ভলিয়ুমটা হয়ত একটু বেশী ছিল। একটু জোরে কথা বলতে হচ্ছিল। সেই সময়ে সঞ্জীব কি একটা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ সঞ্জীব বলল – ‘কেউ যদি ডিকশনারিটা নিয়ে কেউ একটা সিরিয়াল করত, কি ভালো হত বলতো।’
‘মানে? ওরকম আবার কিছু হয় নাকি?’
‘কেন হবে না? এই সিরিয়ালগুলোর কোন মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই। ঘটনাও এগোয় না। একই কথা ঘ্যান ঘ্যান, প্যান প্যান, ঘ্যান ঘ্যান, প্যান প্যান। তার উপর মাঝে মাঝে কি না? রিক্যাপ! এর আগে কি হয়েছে। ডিকশনারি থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন দশ-বারোটা শব্দ নিয়ে যদি ওই ঘ্যান ঘ্যান, প্যান প্যান করত, আমার মত অনেকের উপকার হত।’
‘তুমি বানিয়ো।’
সঞ্জীব মল্লিকার মাথা থেকে হাঁটু অবধি চোখ বুলিয়ে, ‘তুমি আমার প্রোডিউসার হবে?’ বলে এক চোখ টিপেছিল হেসেছিল।
‘ছিঃ! শুধু বাজে কথা।’
তারপর সঞ্জীব ডায়েরীটা টেনে লিখেছিল –
আমরা যদি কোন সবুজ ডানার পাখি হতাম
দুই পায়ে উঁচু হয়ে আমি তীব্র আবেগে
ডানা ঝাপ্টানি দিতাম তোমার বুকে
আমার ডানায় লাগত তোমার বুকের স্পন্দন
উড়ে যেতাম এই বদ্ধ ঘর ছেড়ে
উপরে,
অনেক অনেক উপরে
আমাদের সবুজ ডানায় লাগত হালকা নীলের আভা
ডুবন্ত সূর্যের আলোয় গোলাপি আকাশে রঙের ছটায়
মাখামাখি করে নিরালায় নিভৃতে
বানাতাম আমাদের বাসর ঘর।
একখানা মোমবাতি পুড়ে শেষ হতে যতক্ষণ লাগে
আমাদের ভাবনার রেশ বড় জোর তার চেয়ে বেশী না
তাও শেষ হওয়ার আগে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে ফেলার মত করে
কোমরে আঁচল টেনে তুমি বসলে একখানা ঊর্ধ্বমুখী ফণা তুলে
যেন একটু এগোলেই একটা ছোবল।
মল্লিকা আর জিজ্ঞেস করে নি এটা কার লেখা। প্রশ্নটা মনেই থেকে গেছে। এইটেই সঞ্জীবের শেষ লেখা ওই ডায়েরীতে। মল্লিকা মাঝে মাঝে পড়ে। আজ ডায়েরীটা টেনে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আর একবার পড়তে লাগল।
এমন সময়ে দরজায় কলিং বেলটা বেজে উঠল। মল্লিকা ডায়েরীটা টেবিলের উপরে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে দেখে ওর মা দরজা খুলেছে, আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জীব।
সঞ্জীবকে দেখে মল্লিকার শরীর দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউ নেমে গেল। একবার মনে হল, মাকে সরিয়ে ও নিজে যায় সঞ্জীবের সামনে। ঠিক তখনই বিবর্ণ সব ইচ্ছাগুলো একসাথে হয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল, মনে হল বুকের মধ্যে যেন পাখোয়াজ বাজছে, তার উপর কানের পাশের শিরা দুটো বেতালে দপ দপ করছে। মল্লিকা দরজার পর্দাটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। মল্লিকার মা বললেন, ‘দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসো।’
সঞ্জীব ঘরে ঢুকে আগের মতই একই জায়গায় জুতোটা খুলে রাখল। সঞ্জীবের জুতো রাখার একটা নির্দিষ্ট জায়গা হয়ে গিয়েছিল ওদের দরজার পাশে। সঞ্জীব ছাড়া কেউ ওখানে জুতো রাখত না। মল্লিকা লক্ষ করল এতদিন কেউ ওখানে জুতো রাখে নি; যেন সঞ্জীবের জন্যেই জায়গাটা ফাঁকা রাখা ছিল। জুতোটা খুলে সঞ্জীব সোফায় বসল। মল্লিকা পর্দার আড়াল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
কানের পাশে শিরা দুটো তখনো দপ দপ করে যাচ্ছে। সঞ্জীব কি সব বলছে ওর মাকে। মল্লিকা দরজার অনেকটা কাছে এসে শোনার চেষ্টা করল। কিছু কিছু ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা শুনতে পেল বটে তবে ঠিক করে কিছু বুঝতে পারল না। বাইরে টিভিটা তখনো চলছে। মল্লিকার ওর মায়ের উপর বিরক্ত হল। কেন যে টিভিটা চালিয়ে রেখেছে? কিছু শুনতে না-পাওয়ায় রাগ করে নিজের চেয়ারে এসে বসল। ভাবতে চেষ্টা করল, আজ হঠাৎ এতদিন পরে সঞ্জীব কেন এলো?
কিছুক্ষণ গল্প করার পরে মল্লিকার মা মল্লিকাকে ডাকলেন। বললেন, ‘সঞ্জীব এসেছে।’
মল্লিকার মনে মনে ভীষণ রাগ হল। ভাবল, এতক্ষণ লাগল আমাকে ডাকতে? ও তো আমার জন্যেই এখানে এসেছে। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি এই মুহূর্তের জন্যে। একবার ভাবল বলে, তাতে আমার কি? আমাকে ডাকছ কেন? অন্যদিন হলে হয়ত বলেই দিত, বা বলত আমার মাথা ধরেছে, বা কোন উত্তর না-দিয়ে বিছানায় ঘুমের ভান করে পরে থাকত। আজ মনে হল সব যেন সঞ্জীবের সাজানো। এইসব হবে বলে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। মল্লিকার মনে হল ও একটা সম্মোহনের ভিতর দিয়ে চলেছে; আস্তে আস্তে করে ওর ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলল, ‘কি হয়েছে?’
‘সঞ্জীব এসেছে।’
মল্লিকা বলতে চাইল, তো? কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘ওঃ আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
মল্লিকা এসে বসতেই মল্লিকার মা ‘আমি একটু চা বসাই’, বলে উঠে গেলেন। মল্লিকা বলল, ‘কি ব্যাপার?’
‘কেন কিছু শোনো নি?’
‘কোত্থেকে?’
‘এই যে এতক্ষণ বলছিলাম।’
মল্লিকা জানে এই বাড়ির আনাচ-কানাচ সব সঞ্জীবের জানা। বলল, ‘আমি তো…’
সঞ্জীব থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘জানি, ঘুম থেকে উঠে চুল আঁচড়ে এলে। তাইতো?’
মল্লিকা মাথা নিচু করে নিল। বুঝল ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ও শুয়ে ছিল না। নিজের উপরে ভীষণ রাগ হল। কেন যে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো। একটু সময় নিয়ে বের হলে একটা জবাব দিতে পারত। তবে ভাবল, সঞ্জীবের যা চোখ, কিছু না-কিছু একটা ঠিক বের করে নিত। মল্লিকা বসে ওড়নার কোনাটা নিয়ে একটা গিট পাকাতে লাগল।
সঞ্জীব বলল, ‘UPSC-র ফাইনাল রেজাল্ট বের হয়েছে। পোস্টিং কোথায় হবে এখনো জানি না। সম্ভবত বাইরে কোথাও।’ সঞ্জীব থামল। মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামিয়ে ঢাকনা খোলা মাত্র যেরকম বাষ্প বেরিয়ে আসে, এই কথা শুনে মল্লিকার চোখ দিয়ে সেইরকম একটা খুশীর উষ্মা বের হয়ে এলো। বলল, ‘সে খবর এতদিন পরে জানাতে এলে!’
সঞ্জীব বলল, ‘কাল রাতে জানতে পারলাম।’
‘তাই সবার শেষে আমাদের কথা মনে পড়ল।’
‘তোমার কি তাই মনে হয়? তুমি কি এখনো আমার উপরে রাগ করে আছো?’
আজ সারাদিন ধরে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মল্লিকা মনে মনে ভাবছিল, আজ কিছু একটা হবে। তবে সেটা যে এমনই একটা কিছু হবে তা কল্পনা করে নি। বলল, ‘রাগ করেছিলে তুমি, আমি করি নি। এতদিনে একবারও এলে না। এখন যাওয়ার সময় বলতে এলে?’
সঞ্জীব বুঝতে পারছিল না যে মল্লিকার আজ কি কারণে এত পরিবর্তন। নিজেকেই দোষী মনে হতে লাগল সঞ্জীবের।
এমন সময়ে জুঁই কোত্থেকে বাড়ি ফিরল। ঘরে ঢুকে সঞ্জীবকে দেখে অবাক। আরও অবাক পাশে মল্লিকাকে দেখে। বলল, ‘কি ব্যাপার সঞ্জীব-দা? এতদিন পরে?’ বলেই ঝুপ করে সঞ্জীবের একদম গা-ঘেঁসে বসে পড়ল।
সঞ্জীব কিছু বলার আগেই মল্লিকা বলল, ‘UPSC দিয়ে চাকরী পেয়েছে। তাই জানাতে এসেছে যে কয়েকদিন পরে চলে যাবে।’
‘তার মানে? ভালোই হল, আমি মাঝে মাঝে আপনার ওখানে বেড়াতে যেতে পারব। এই এক জায়গায় বোর হয়ে গেলাম। কবে খাওয়াচ্ছেন?’
মল্লিকা ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর কি এছাড়া আর কোন কথা নেই?’
জুঁই সঞ্জীবের পাস থেকে উঠে এসে মল্লিকার পাশে বসে গান ধরল –
যদি তুমি আর আমি
পাশাপাশি বসে
কাটিয়ে দিতাম মোরা কিছুটা সময়
কতো ভালো হত
যদি তোমাতে আমাতে
চোখে চোখে চেয়ে
কাটিয়ে দিতাম মোরা কিছুটা সময়।
তারপর মল্লিকাকে একটু সঞ্জীবের দিকে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দিদি আমাকে কিছুতেই আপনার সাথে বসে গল্প করতে দেয় না। কতদিন আপনার সাথে এইসব হয় নি। তবে আজ থাক আরেকদিন হবে।’
সঞ্জীব জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখনো চালিয়ে যাচ্ছো?’
মল্লিকার মা চা নিয়ে এসে বললেন, ‘তুমি যে ওর মাথায় কি ঢুকিয়ে দিয়েছ। ওর সারাক্ষণ এই-ই চলে।’
সঞ্জীব চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে, ‘মুখ ভার করে থাকার থেকে এটা অনেক ভালো’, বলে মল্লিকার দিকে তাকালো।
মল্লিকার মা চা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। সঞ্জীব মন দিয়ে চা খেতে লাগল। জুঁই চলে গেছে ওর ঘরে। চুপচাপ বসে চা খেতে মল্লিকার ভীষণ অস্বস্তি লাগল। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কবে জানতে পারবে পোস্টিং কোথায় হবে?’
‘এখনো সেসবের কিছুই জানি না।’
‘সেখানে কি থাকার জায়গা দেবে নাকি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে?’
‘তাও জানিনা। শুনেছি ট্রেনিং পিরিয়ডে হোস্টেল গোছের কিছু একটা থাকে।’
‘কতদিন পরে আসবে আবার?’
সঞ্জীব টের পেল, প্রশ্নটা সামান্যই তবে আবেগের তীব্রতাটা স্পষ্ট। বলল, ‘তুমিও চলো আমার সাথে। বলো, রাজি আছো? আমি আসলে সেইটা জানার জন্যেই এসেছি।’
‘মানে তোমার সাথে? মানে বিয়ে করে?’
‘হ্যাঁ।’
মল্লিকা কিছু বলল না। সঞ্জীব বলল, ‘আমার যেখানে পোস্টিং হবে সেখানে চাকরী করবে।’
মল্লিকা তাও কিছু বলল না। সঞ্জীব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, ভেবে বোলো।’
মল্লিকা এবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার তো বদলির চাকরী হবে। এক জায়গায় কয়েক বছরের বেশী থাকতে পারবে না।’
‘তা ঠিক। এই চাকরীর এইটেই সবচেয়ে অসুবিধা। তবে নানান জায়গায় থাকার অনেক মজাও আছে। অনেক কিছু জানা যায়।’
‘ওই এক কথা – অনেক কিছু জানা যায়। তাহলে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াও, আরও অনেক বেশী কিছু জানতে পারবে।’
‘তুমি সায় দিলে আমি তাও করতে পারি।’
মল্লিকা কিছু বলল না। সঞ্জীব ভেবেছিল এরমধ্যেই একটা তর্কাতর্কি বেঁধে যাবে। মল্লিকা বলবে, নিজের ক্যারিয়ারের জন্যে আমার চাকরীটা জলাঞ্জলি যাক। মেয়ে বলে আমাদের কোন মূল্য নেই। অথচ, আজ কিছুই বলল না। কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। মল্লিকা চা শেষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘কবে জয়েন করতে হবে?’
‘এখনো কিছু জানায় নি।’
‘কতদিনের ট্রেনিং?’
‘মাস ছয়েকের মত কিছু একটা হবে। দেখে বলতে পারব।’
‘তারপরে কোথায় পোস্টিং হবে বলে মনে হয়?’
সঞ্জীব ওর এই কথার উত্তর দিল না। বলল, ‘তোমাকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে।’
মল্লিকা বলল, ‘আজ একজনের সাথে আলাপ হল। ওর সাথে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল সব যেন তোমার শেখানো।’
‘কে?’
‘আমার এক কলিগের বান্ধবী।’
‘যে তোমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ।’
‘সে কি বলল?’
‘অনেক কথা। ওর সাথে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল। না থাক…।’
‘সে তোমাদের কথা তোমাদের মধ্যেই থাক। তবে আমি যা জিজ্ঞেস করলাম সেটা ভেবে বোলো।’
‘আমার মনে হয় তোমার সাথে না-গিয়ে আমার কোন উপায় নেই।’
শুনে সঞ্জীব অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘এইরকম বলছ কেন? তুমি কি বাধ্য হয়ে রাজি হচ্ছো? সেইরকম কিছু হলে আগে থেকেই বোলো।’
‘বাধ্য না। নিজের থেকেই বলছি। তুমি বুঝবে না।’
‘তোমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে দেখছি।’ সঞ্জীব মনে মনে ভাবল, হয়ত কিছুদিন সেপারেট হয়ে যাওয়ার ফল। তারপরে আবার সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সত্যি মন থেকে বলছো তো। আমি এই নিয়ে পরে আবার কোন অশান্তি করতে চাই না।’
মল্লিকা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, মন থেকেই বলছি। তবে যেখানে থাকব সেখানে আমাকে চাকরী করতে দিতে হবে।’
‘তা করবে। সারাদিন আমি বাড়ি থাকব না, তুমি একা একা কি করবে? আমি তো চাকরী করতে না করিনি কখনো। শুধু ভাবছি। তোমার এত পরিবর্তন …’
‘বললাম না? আজ একজনের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু বুঝতে পারলাম। আর তখন থেকেই শুধু ভাবছি। আর তারপরেই তুমি এলে।’
‘তোমার বান্ধবীকে আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘জানি তো। আমি ওকে যখন বললাম, ও বলল তোমাকে একদিন নিয়ে যেতে।’
‘আর তুমি অমনি বললে, হ্যাঁ নিয়ে আসব রে।’
‘হ্যাঁ, কেন আমি কাকে কি বলব তাও কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে নাকি?’
‘নিশ্চয়ই না। কবে নিয়ে যাবে আমাকে?’
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25