Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। সতের ।।

সেদিন শনিবার। অফিসে থেকে বের হয়ে রত্নাকর মল্লিকাকে নিয়ে গেল শম্পার ফ্ল্যাটে। শম্পার সম্পর্কে আগে যা শুনেছে আর রাস্তায় আসতে আসতে রত্নাকরের কাছে যা শুনল, তাই দিয়ে মল্লিকা শম্পা সম্পর্কে মনে মনে একটা ধারণা করে নিয়েছিল। মল্লিকা শম্পাকে যেমন ভাবতে চেয়েছিল তার মনও সেই দিকে উস্কানি দিয়ে গেল। এইসব ক্ষেত্রে বিবেচনার চাইতে অভিপ্রায় বেশী শক্তিশালী হয়। এখেত্রেও তাই হয়েছে।

ওরা যখন শম্পার ফ্ল্যাটের কাছাকাছি পৌঁছালো, মল্লিকা বুকের ভিতর দপ দপ করতে শুরু করল। একবার ভাবল, রত্নাকরকে বলে, আজ থাক, অন্য একদিন আসব। বলল, ‘শম্পা জানে তো যে আজ আমরা আসব ওর বাসায়?’ শম্পার ফ্ল্যাটে পৌঁছে কলিং বেল বাজাতেই যে বের হয়ে এল, তাকে দেখে মল্লিকা অবাক হয়ে গেল। যেন ছবিতে আঁকা কোন এক মেয়ে জীবন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে।

মল্লিকা যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকল। রত্নাকর বলল, ‘এই হল মল্লিকা, আর ও শম্পা।’

শম্পা বলল, ‘ভিতরে আসো তোমরা।’

রত্নাকরের পিছন পিছন মল্লিকা ঘরে ঢুকল। তারপর শম্পা ওদের সোফায় বসতে দিয়ে নিজে একখানা চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসল।

মল্লিকা অবাক হয়ে চারিদিকে দেখে বলল, ‘তোমার ঘরটা তো খুব সুন্দর করে সাজানো।’

শম্পা বলল, ‘হাতে সময় থাকলে ওসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এই আর কি।’

মল্লিকা বলল, ‘আর তুমিও যে এত সুন্দরী, সেটা আমি জানতাম না।’

মল্লিকা ভেবেছিল, এই শুনে শম্পা একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব দেখাবে।

শম্পা বলল, ‘গরীব ঘরে সুন্দরী হয়ে জন্মানোর যত রকম অসুবিধে, সবগুলো আমাকে পোহাতে হয়েছে। এখন ভাবি আমার এত রূপ না-থাকলেই বোধহয় ভালো হত।’

তারপরে বলল, ‘একটু বসো। চায়ের জলটা বসিয়ে আসি।’ এই বলে সেখান থেকে শম্পা সেখান উঠে গেল।

শম্পা যখন রান্নাঘরে ঢুকে গেল মল্লিকা ফিসফিস করে রত্নাকরকে বলল, ‘তুমি তো বলনি যে শম্পা এত সুন্দরী।’

‘কোনদিন সেসব কথা জিজ্ঞেস করো নি।’

‘বাঃ আমি কি করে জানবো?’

এমন সময়ে শম্পা চায়ের জল বসিয়ে রান্নাঘর থেকে ফিরত এলো। রত্নাকরকে বলল, ‘চা খেয়ে তুমি আমাদের জন্য কিছু একটা নিয়ে এসো। এখানে বসে আমাদের মেয়েলি কথা কি শুনবে?’

মল্লিকা ফিক করে হেসে রত্নাকরের দিকে একবার তাকাল। তারপরে শম্পাকে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। তোমার সম্পর্কে রত্নাকরকে দুএকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু ও কিছুই বলে না। তবে আমার বোন জুঁইয়ের কাছে ও পারে না। যা শুনেছি টুকটাক ওর কাছ থেকে শুনেছি।’

শম্পা বলল, ‘তুমি যা শুনেছ, নিশ্চয় ঠিকই শুনেছ।’ তারপরে রত্নাকরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যতটুকু জানি ও বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলতে পারে না।’ এই বলে শম্পা আবার উঠে গেল রান্নাঘরে।

কিছুক্ষণ পরে চা আর বিস্কুট নিয়ে ফিরত এলো। মল্লিকাকে চা দিয়ে বলল, ‘আমার খুব ভালো লেগেছে যে তুমি এলে। এখানে আমার খুব একটা বন্ধু-বান্ধবী নেই।’

মল্লিকা কিছু বলল না। চায়ে চুমুক দিতে লাগল।

শম্পা রত্নাকরকে দেখিয়ে বলল, ‘আর ওর সাথে ঘুরে বেড়াব সেটাও হয় না।’ তারপরে নিজে এক চুমুক দিয়ে বলল, ‘তাছাড়া জানো তো আমি অনেকদিন বাইরে ছিলাম। কয়েকদিন আগেই ফিরেছি।’

মল্লিকা বলল, ‘বুঝলাম। সেইজন্যেই রত্নাকর এই সোমবার অফিস ডুব মেরে ছিল।’

‘সেটা আমার জন্যে না। ওর নিজের কিসব কাজ ছিল।’

‘ও তোমার চিঠি পাওয়ার পরেরদিনও অফিস যায় নি।’

‘তাই নাকি?’ তারপর রত্নাকরকে জিজ্ঞেস করল, ‘কই সেকথা তো বলো নি আমাকে?’

রত্নাকর কিছু উত্তর দিল না। তাড়াতাড়ি চা শেষ করে পেয়ালাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমি দেখি কি পাওয়া যায়। তোমারা গল্প করো।’

রত্নাকর বের হয়ে গেল। শম্পা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে মল্লিকার একদম পাশে এসে বসল। রাতপরে বলল, ‘এবার জমিয়ে গল্প করা যাবে।’

মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘রত্নাকরকে যেতে বললে কেন?’

‘আমাদের মেয়েলি কথায় ও অস্বস্তিতে পড়বে।’

‘তুমি কি এখন এখানেই থাকবে নাকি আবার বাইরে কোথাও যেতে হবে?’

‘এখন এখানেই থাকব। তবে এই বাড়ীটা ছেড়ে দিতে হবে। আর একটা কাজ খুঁজতে হবে।’

মল্লিকা বুঝল শম্পার কথাবার্তা মিষ্টি তবে স্পষ্ট বাক্যে কথা বলে। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ধরনের কাজ খুঁজছো?’

‘জানি না এখনো। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই খোঁজা শুরু করব।’

‘রত্নাকরকে বলো। অফিসে ওর সাথে অনেকেরই খুব ভাল সম্পর্ক। ওখানে তো প্রায়ই লোক নেয়।’

‘না, ওকে বলে কাজ নেব না।’

‘কেন? ওর সুপারিশে কাজ পেলে তোমার -‘

‘তুমি জান তো নিশ্চয়ই আমি এতদিন কি করতাম। ফলে আমার অনেক চেনা লোক আছে যাদের বললে এক মুহূর্তে একটা কাজ পেয়ে যাব। কিন্তু আমি তাদের থেকে দূরে থাকতে চাই।’

মল্লিকা একটু চমকে উঠল। ও এতটা আশা করে নি। শম্পার কথা শুনে ওর মুখটা ফেকাসে হয়ে গেল। শম্পার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। শম্পা সেটা লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমার এতে অস্বস্তি পাওয়ার কোন কারণ নেই।’

মল্লিকা বলল, ‘তোমার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি তাতে আমার দুঃখ হয়।’

‘আমার তো ভাগ্য ভালো। আমি এখন ওসবের থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। এক দুর্ঘটনায় ওর সাথে দেখা হয়ে গেল। সেও বিয়ে করে নি। এর চেয়ে বেশী আর কি চাই? আগে দুঃখ হত, এখন আর হয় না।’

‘তোমরা কি বিয়ে করবে ঠিক করেছো?’ প্রশ্নটা করেই মল্লিকা নিজেই অস্বস্তিতে পড়ল।

শম্পা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা গলায় কিন্তু স্পষ্ট করে বলল, ‘সমর্থন না করো সে তোমার মর্জি, তবে অপমান করাটা কি ঠিক?’

মল্লিকা তাড়াতাড়ি শম্পার হাতটা ধরে বলল, ‘আমি কোনরকম অপমান করার জন্যে বলি নি। বলতে চেয়েছিলাম, কবে বিয়ে করবে সেটা কি ঠিক করেছ?’

শম্পা মুহূর্তে আগের মত হয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘এর আগে দুই বার ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। প্রথমবার ভীমপুরে। তখন ও পড়াশুনো করছে। আমিও। বাড়ীতে শুনলাম আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। মামা ছেলে দেখছে। মামাকে আমার কোনদিনও ভালো মনে হত না। ওকে এসে বললাম। ও এমন ভয় পেল যে – যাকগে। তারপরের ঘটনা নিশ্চয় শুনেছ ওর কাছে। তখন ওর উপরে খুব রাগ হত। তারপরে এত বছর পরে আবার দেখা হল। পুরানো প্রেম জেগে উঠল। ঠিক করলাম বিয়ে করব। তারপর দুজনে অন্য কোথাও চলে যাব। শেষ অবধি সেই বারও বিয়েটা হল না। এবার আর তাই কোন পরিকল্পনা করি নি এখনো। এরমধ্যে ওর মত যদি বদলে না-থাকে তো হবে একদিন।’

শুনে মল্লিকা একটু কেঁপে উঠল। মনে হল ওর দম নিতে অসুবিধা হচ্ছে। কথা বলতে পারল না। জুঁইয়ের কথা মনে পরে গেল। ঠিক করল, আর যাই হোক এখানে জুঁইয়ের কথা তোলা যাবে না। হয়ত কখনোই বলা যাবে না। মল্লিকা বুঝল, স্বার্থ ব্যাপারটা এমনই যে সেখানে ভাগাভাগির ভাগীদার হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করাটা খুব কষ্টের হয়।

মল্লিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে শম্পা বলল, ‘আমার গল্প তো অনেক শুনলে। তোমার কথা কিছু বল।’

‘বাবা মারা গেলেন আমি যখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। মা বাবার অফিসে চাকরী পেল। তারপর আমি পাশ করে এই চাকরীটা পেয়ে গেলাম। সেই থেকে একইভাবে চলছে। বোনটা গত বছর কলেজে ঢুকেছে। ওর পড়া শেষ না-হওয়া পর্যন্ত এইভাবে চলবে।’

‘তারপর?’

‘মায়ের চিন্তা আমার বিয়ে নিয়ে। আর আমার চিন্তা বোনের পড়াশুনো নিয়ে।’

‘ও বলছিল, তুমি কারো সাথে প্রেম করতে। খুব ভালো ছেলে। তারপর নাকি -‘

মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি রত্নাকরকে কি বলে ডাকো?’

শম্পা বলল, ‘আমরা ছোটবেলায় একগ্রামে বড় হয়েছি। তখন থেকেই ওকে রতন-দা বলে ডাকি। এখনো তাই চলছে।’

‘আমার সাথে কথা বলার সময়ে তুমি প্রতিবারই রত্নাকরকে ‘ও’ বলে বললে। সঞ্জীব, যার সাথে আমি প্রেম করতাম, যে কোন কারণেই হোক, সঞ্জীব আমার কাছে কখনো ‘ও’ হয়ে ওঠে নি, সঞ্জীবই থেকে গেছে।’

এর মর্মার্থ বুঝতে শম্পার একটুও অসুবিধে হল না। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না।

একসময়ে শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘সঞ্জীবকে তুমি কি ভালবাসতে না কি একজন টাইম পাস ছেলে-বন্ধু ছিল?’

মল্লিকা বলল, ‘সঞ্জীবের মধ্যে একটা সম্মোহনী ব্যাপার আছে। ওর সাথে কিছুক্ষণ থাকলেই বুঝতে পারবে যে ওকে ভাল না-বেসে থাকা যায় না। ওর দেওয়া সব বই, আমার ডায়েরীতে ওর লেখাগুলো এখনো পড়ি।’

‘তাহলে?’

‘আমি মেয়ে বলে কি আমার কোন স্বাধীনতা নেই? বলে বিয়ের পরে ওর সাথে থাকতে হবে। তাহলে আমার বোনের পড়াশুনো কে করাবে?’

‘আপত্তিটা কিসের? তুমি যা বললে, তাতে তো মনে হয় সঞ্জীবও নিশ্চয় ভালো চাকরী করে। আজ না-করলেও, কাল করবে। তোমার টাকা তোমার বাড়ীতে দিলে সঞ্জীব কি আপত্তি করবে?’

‘আজ না করুক, কাল করতে পারে।’

‘পারে। তবে করবেই যে সেটা বুঝলে কি করে?’

‘আমাদের সমাজে মেয়েদের কোন স্বাধীনতা নেই। তুমি নিজেকে দিয়ে বোঝ না?’

শম্পা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘বোধহয় বুঝি, তবে আমি যা বুঝেছি সেটা তোমার বোঝার সাথে মেলে না।’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘স্বাধীনতাটা কি সেটা বলতে পারো?’

‘মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়; মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই, সোশ্যাল ইকুয়ালিটি নেই; সব জায়গায় জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন করা হয় – অন্তত এইগুলো থেকে মুক্ত হলে বলব আমরা কিছুটা স্বাধীন।’

‘তার মানে তোমার লিস্ট আরো লম্বা। তা হোক। তবে এইগুলো যে শুধু মেয়েদের উপর চাপানো আছে – এই ধারণা থেকে যতদিন না বের হয়ে আসতে পারছ, ততদিন এর কিছুই হবে না।’

‘তার মানে?’

‘জানো তো, এখন আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া, স্মল পক্স এইসব আর হয় না। কারণ, সেগুলো সমাজ থেকে উৎখাত করা হয়েছে। যদি শুধু বড়লোক বা শুধু ছেলেদের মধ্যে থেকে তাড়ান চেষ্টা করা হত, ওসব যেত না। তুমি যেসবের কথা বললে, সেগুলো সামাজিক অপূর্ণতা। এইগুলো ভাগ-বাটরা করে দেখা হয় বলেই সমাজ থেকে আজও তা গেল না।’

‘তুমি কি বলতে চাও সমাজে মেয়েদের সমান অধিকার আছে?’

‘তোমার অধিকার যার সাথে সমান-সমান করতে চাও, তার কি নিজের আধিকারের কোন সঠিক মাপ আছে? কার সাথে সমান করতে চাও?’

‘আমাদের সমাজে মেয়েরা কম পড়াশুনো করে, আসলে করতে দেওয়া হয় না।’

‘আমার বাসায় সকাল বেলা যে মেয়েটা এসে কাজ করে যায় সে যে পরিবার থেকে আসে সেই পরিবারে ছেলেরাও পড়াশুনো করে না। এখানে ছেলে মেয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, এটা অর্থনৈতিক।’

মল্লিকা রেগে বলল, ‘ও মেয়েটা কি তোমার বাড়ি থেকে কাজ করে অনেক রাতে একা ফিরতে পারবে?’

‘রাতে কেন? দিনের বেলাতেও একটা ছেলে পকেটে অনেক টাকা নিয়ে একা রাস্তায় চলতে ভয় পায়।’

‘তুমি বলতে চাও মেয়েদের ডিস্ক্রিমিনেট করা হয় না?’

‘আমি বলছি, শুধু মেয়েদের ডিস্ক্রিমিনেট করা হয় – এইটা ঠিক না। যাদের ক্ষমতা আছে তারা অন্য সবাইকেই ডিস্ক্রিমিনেট করে। যেহেতু মেয়েদের কম টাকা দিয়ে কাজ করানো হয় তাই আমরা নিজেদের প্রাপ্য ঠিকঠাক পেলেই হল, বাকি সব চুলোয় যাক – এ হল সেক্টারিসিম। এই যদি মনোভাব হয় তাহলে এই দেখে আরেকটা গ্রুপ একই কথা বলবে। তাই দেখে আরেকটা। সব মিলিয়ে, সেটা হচ্ছে একটা প্রতিযোগিতা। তাহলে সোজাসুজি তাই করো না কেন?’

‘দরকার পড়লে তাই করা উচিৎ।’

‘এই প্রতিযোগিতায় কেউ না কেউ পিছিয়ে পড়বে। সেদিন সেও একই কথা বলবে। এর সম্পূর্ণতাটা কোথায় পাবে? আর এতে কারুর সহযোগিতা তো পাবেই না, সহানুভূতিটাও পাবে না।’

‘আমি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।’

‘আমার বাসায় যে মেয়েটা কাজ করতে আসে ওর পরিবেশে ওর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সোশ্যাল ইকুয়ালিটি সবই আছে। তাহলে কি বলবে নারী স্বাধীনতা বলতে যা যা বললে ওর তা আছে? স্বাধীনতা সার্বিক ভাবে হয়, ওরকম নারী, পুরুষ, নাবালক, বৃদ্ধ, ভাগে ভাগে হয় না।’

‘তুমি কি বলতে চাও এই মনোভাবের কোন মূল্য নেই?’

‘যদি কিছু করতে চাও, সামাজিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, সামগ্রিক উন্নতির কথা ভাব, কেবল নারী স্বাধীনতা করে কিছু হবে না। তাতে কেবল অন্যের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে কুটকাচালি করে নিজে হয়ত আনন্দে থাকবে। আসল কাজ কিছু হবে না।’

‘তুমি কি বলতে চাইছ?’

‘আমরা ডিভাইড অ্যান্ড রুলটা অনেকবার দেখে দেখে এতদিনে সকলে জেনে গেছি। তাই ওটাকে এড়িয়ে রাজনৈতিক নেতারা সেক্টারিসিমের অন্য একটা আকার নিয়ে এখনও একই চালাকি করে যাচ্ছে। দেখাতে চায় আমরা তোমাদের নিয়ে কত ভাবছি। প্রথমে তোমরা দল করো, তারপরে আমাদের কাছে এস, আর আমাদের ভোট দিয়ে যাও। এরা একদিকে ছেলে-মেয়ের সমতা নিয়ে অনেক কিছু বলে, তারপরেই মেয়েদের জন্য রিজার্ভেশন করে বুঝিয়ে দেয়, তোমরা দুর্বল, তোমরা আলাদা, ওইটুকু নিয়ে আলাদাই থাকো, সবাই মিলে এসো না।’

শম্পা থামল। মল্লিকাও কিছু বলল না।

শম্পা বলল, ‘স্বাধীনতার উদ্যোগে আমি আছি, নারী স্বাধীনতার আন্দোলনে আমার মত নেই। তার কারণ, কেউ যদি আমার স্বাধীনতা থেকে আমাকে বঞ্চিত করে তখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যায়। যার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন করতে চাইছ, সেই কি স্বাধীন? এতো যেন এক ভিখারি আর এক ভিখারির কাছে গিয়ে বলা যে তুই আমার চেয়ে বেশী ভিক্ষে পেয়েছিস, তোর থেকে আমাকে কিছুটা দে। ওরকমভাবে নারী উন্নতি হয় না, হলে গোটা সামাজিক উন্নতি হয়, নাহলে কারুরই কিছু হয় না।’

মল্লিকা চুপ করে থাকল।

শম্পা বলল, ‘দ্যাখো, কোন কথা থেকে কোন কোথায় চলে এলাম।’

মল্লিকা বলল, ‘আমি শুধু একটা কথা ভাবছি। তোমার সাথে যদি সঞ্জীবের কোনদিন দেখা হয় তাহলে কি হবে?’

‘আমার স্কুল পাশ করা বিদ্যা মাত্র। মাথা খারাপ, আমি সঞ্জীবের সামনে মুখ খুলে মরি আর কি?’

‘সেই বিদ্যে নিয়ে আমার সামনে তো মুখ খুললে।’

‘সেটার কারণ, যদি তোমার ভুল ধারণাটা ভাঙ্গাতে পারলে, তুমি নিজে সুখী হবে। এর বেশী আর কিছু না।’ তারপরে কি একটা ভেবে শম্পা আবার বলল, ‘একদিন সঞ্জীবের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দেবে?’

‘কতদিন কথাই বলি নি ওর সাথে। আমি পারব না।’

শম্পা বলল, ‘মল্লিকা, সঞ্জীব কিন্তু এর মধ্যেই তোমার ‘ও’ হয়ে গেছে, সেটা কি টের পেয়েছ?’

এমন সময়ে দরজায় কলিং বেলের শব্দ হল। শম্পা ‘ও ফিরে এলো’, বলে নিজেই হেসে ফেলল। তারপরে উঠে দরজা খুলে দিল। রত্নাকর ঘরে ঢুকে চপ, কাটলেট, আরো কিছু টেবিলের উপরে রাখল।

শম্পা সেগুলো প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। খেতে খেতে তিনজনের আরও কিছুক্ষণ গল্প হল। তারপরে মল্লিকা বলল, রাত হয়ে গেল। এখন না-উঠলে আর ট্যাক্সি পাব না।

শম্পা রত্নাকরকে বলল, ‘যাও মল্লিকাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। এত রাতে ওকে ট্যাক্সিতে একা ছেড়ো না।’

মল্লিকা কোন আপত্তি করল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25