।। ষোল ।।
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে অনেক রাত অবধি গল্প করে দুজনে শুতে গেল। পরের দিন চোখ ঘুমে যখন সকাল হল, রত্নাকরের উঠতে ইচ্ছে করল না।
শম্পা কখন উঠে পড়েছে রত্নাকর টের পায় নি। ওর ঘরের সবদিকের পর্দা টেনে অন্ধকার করে রেখে গেছে। বেশ বেলা করে রত্নাকরের ঘুম ভাঙল। রত্নাকর ঘড়ি দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসল। তারপর মুখ-চোখ ধুয়ে বাইরে এসে দেখে টেবিলের উপরে জলখাবার সাজিয়ে রাখা। রত্নাকরের পায়ের শব্দে শম্পা কোন একটা ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে এলো।
শম্পাকে দেখে রত্নাকরের মনে হল, ও সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে। শম্পা প্লেট নামিয়ে জল খাবার বাড়তে লাগল। রত্নাকর নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে লাগল। শম্পা স্নান করে বের হলে শম্পার গা দিয়ে এই গন্ধটা বের হয়। আগেও পেয়েছে। জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তুই স্নান করে বের হলে তোর গা থেকে এইরকম একটা মিষ্টি গন্ধ বের হয় কেন?’
‘কি গন্ধ?’
এমন সময়ে রান্নাঘরের ভিতর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি এখন কি চায়ের জল বসাবো?’
শম্পা বলল, ‘পাঁচ মিনিট পরে বসা।’
মেয়েটা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখে আবার রান্নাঘরের ভিতরে চলে গেল।
রত্নাকর শম্পার ওড়নার একটা জায়গা টেনে একটু শুকে বলল, ‘না, এটা তোর গা-থেকে আসছে। আমি এর আগেও পেয়েছি।’
শম্পা বলল, ‘ঠিক আছে, এর পরেও পাবে। এখন খেয়ে নাও। না-হলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
জলখাবার খেয়ে, তারপর চা খেয়ে, বেলা দশটা নাগাদ একটা পে-ফোনের বুথ থেকে অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ওর শরীর ভালো নেই।
ফিরে এসে দেখে সব গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখা। তার কিছুক্ষণের মধ্যে কাজের মেয়েটাও চলে গেল। শম্পা এসে বলল, ‘ভাল ফাঁকি দিলে আজ। বল কি করবে এখন সারাদিন?’
এই বাড়িগুলো রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে তাই গাড়ির আওয়াজ তেমন পাওয়া যায় না ঘরের ভিতর থেকে। এই প্রায় দুপুরের নিঃশব্দ একটা সময়, অকাজে মন ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া কি আর করা যায়? রত্নাকর কিছু বলতে পারল না।
শম্পা উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় রত্নাকর বলল, ‘আমাদের সাথে কাজ করে একটা মেয়ে, ওর নাম মল্লিকা। আমি ভাবছি তোর সাথে ওর আলাপ করিয়ে দেব।’
রত্নাকর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। শম্পা ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার সাথে কেন?’
‘আমি এখন যে কাজগুলো করি, আমার আগে ওই করত। মেয়েটা খুব ভাল। আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। বেশ কয়েকবার আমাকে ওদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। ওকে তোর অনেক গল্প করেছি, তাই।’
‘বেশ তো। একদিন নিয়ে এসো।’
রত্নাকরের মনে হল, এটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না তো? শম্পার সাথে আর যাই গল্প করুক অন্য কোন মেয়ের কথা কোনদিন ওঠে নি। ও কিভাবে নিল সেইটে বোঝার জন্য বা একটু সহানুভূতি গড়ে তোলার জন্যই হোক রত্নাকর আবার বলল, ‘জানিস ওর বাবা নেই। অনেকদিন আগে মারা গেছেন। বাড়িতে মা আর বোন থাকে। মল্লিকার মা ওর বাবার অফিসে একটা কাজ পেয়েছে। তবে বুঝতেই পারিস। সেই জন্যেই মনে হয় প্রয়োজনের চেয়ে ও একটু বেশী দায়িত্বশীল। তোর ভালো লাগবে।’
শম্পা ঠিক বুঝতে পারল না। শুধু একটা ‘হু’, বলে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। রত্নাকরের মনে হল, শম্পা আরও কিছু শুনতে চাইছে। তাই বলল, ‘মল্লিকা একজনের সাথে প্রেম করত। ছেলেটার সাথে আমার আলাপ হয় নি তবে যা শুনেছি, খুব ইন্টারেস্টিং ছেলে। একদিন ওরা নিজেদের বিয়ের পরে কি করবে সেই নিয়ে কথা বলতে বলতে ছেলেটা যেই বলল যে বিয়ের পরে মল্লিকাকে ওর সাথে থাকতে হবে। সেই শুনে মল্লিকা আর কোন সম্পর্ক রাখল না।’
‘আর তুমি সেটা বিশ্বাস করলে?’
‘বিশ্বাস, অবিশ্বাসের কি আছে? আমাকে যা বলেছিল, সেটাই বললাম।’
‘আর?’
রত্নাকরের বুঝল ও ঠিকই বুঝেছে, শম্পা আরও কিছু শুনতে চাইছে। কিন্তু কি শুনতে চাইছে সেইটে আন্দাজ করতে পারল না। বলল, ‘আর কি?’
শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কি করতে হবে?’
‘কিছু না। তোর এত গল্প করেছি। তাই ভাবলাম একদিন ডেকে আড্ডা মারব।’
শম্পা মনে মনে কিসব ভাবল। তারপরে বলল, ‘যাও স্নান করে এস। আমি খাবার বারি, নাহলে আবার সব গরম করতে হবে।’
রত্নাকর স্নান সেরে যখন খাবার টেবিলে এলো, শম্পা ততক্ষণে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। শম্পা বলল, ‘সকালে উঠতে দেরী হয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। যা ছিল তাই দিয়ে যা পেরেছি করেছি।’
‘শোন আমি একা থাকি। যা পাই, তাই খাই। অর্ধেক দিন হোটেলে খাই। আমার কাছে এই যথেষ্ট।’
শম্পা বলল, ‘ও’বেলা ভালো কিছু একটা করব।’
রত্নাকর বলল, ‘ও’বেলা মনে হয় হবে না। আমাকে বাসায় যেতে হবে। কাল অফিস কামাই দেওয়াটা ঠিক হবে না।’
‘আমি কি অফিস যেতে মানা করেছি নাকি?’
‘না। আজ যখন অফিস যাওয়া হল না, ভাবছি কতগুলো কাজ জমে আছে, সেগুলোর জন্যে বাসায় যেতে হবে।’
শম্পা খাবারের প্লেটে কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে, আবার যেরকম খাচ্ছিল সেইরকমই খেতে লাগল। এনিয়ে আর কোন কথা বলল না।
খাওয়া শেষ করে সব তুলে রেখে শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘কখন বের হবে তাহলে?’
‘এই অফিসের ভিড়টা বাড়ার আগেই বের হয়ে যাব।’
খেয়ে উঠে রত্নাকর সোফায় বসল। শম্পা কিছুক্ষণ এটা সেটা করে ওর পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ পাশাপাশি কাটল। তারপরে রত্নাকর বলল, ‘এবার উঠি।’
জামাকাপড় বদলে, রত্নাকর চলে গেল।
পরের দিন অফিসে এসে রত্নাকর চুপচাপ থাকল। কাজের কথা ছাড়া কারুর সাথে তেমন কোন কথা বলল না। কেউ ওকে তেমন কিছু জিজ্ঞাসাও করল না। রত্নাকর পারত পক্ষে মল্লিকাকে এড়িয়ে চলল সে’দিন। যে কয়েকবার ওর মুখোমুখি হল, কাজের ব্যস্ততার ভান করে কাটিয়ে গেল। ভেবেছিল, বিকালের দিকে যখন অফিস ফাঁকা হয়ে যাবে, মল্লিকা এসে ওকে জিজ্ঞেস করবে। তখন কি বলবে সেই নিয়ে অনেক রকম জল্পনা-কল্পনা করে বিকালের দিকটা কাটল। মল্লিকা কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করল না। ওর সময়মত ও বাড়ি চলে গেল।
পরের দিনও একরকম একইভাবে কাটল। রত্নাকর যতই মল্লিকাকে কিছু বলার চেষ্টা করে মল্লিকা হয় অন্য কাজে মন দেয়, নাহলে কাউকে ডেকে নিয়ে আসে কাজের কথা বলার অছিলায়। রত্নাকর কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।
রত্নাকর সেদিন আর পারল না। টেবিলে মল্লিকাকে একা দেখতে পেয়ে ওর কাছে গিয়ে সোজাসুজি বলল, ‘শম্পা এসেছে। তোমাকে একদিন ওর বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে।’
‘আমাকে? কেন?’
‘এমনিই, তোমার সব গল্প করেছি ওর কাছে তাই ও দেখতে চায়।’
‘বাবা। আমি যে এতটা তাৎপর্যপূর্ণ সেটা তো জানতাম না। তুমি সব ছেড়ে আমার এত শত কি এমন গল্প করতে গেলে যে শেষমেশ ও আমাকে ডেকে পাঠাল?’
রত্নাকর জানে এটা কোন প্রশ্ন নয়। তাছাড়া দরকারটা তার নিজেরই। তাই এই কথাটাকে অগ্রাহ্য করে বলল, ‘কবে যেতে পারবে?’
‘দেখি। শম্পাকে আমারও দেখার খুব ইচ্ছে আছে।’
অভ্যাসবশত রত্নাকর ভেবেছিল মল্লিকা কিছু জিজ্ঞেস করবে। অন্তত, শম্পা কবে এলো, এখন কোথায় থাকে, হয়ত বা বলবে, যাব না। আশা করে ছিল, অভিযোগের একটা ঝড় উঠবে। ঠিক করে রেখেছিল, মল্লিকাকে বোঝাতে হবে যে কেন ওর একবার শম্পার কাছে যাওয়া উচিৎ। দরকার হলে পীড়াপীড়ি করতে হবে।
দিন কয়েক আগে পাড়ার মোড়ে ইলেক্ট্রিসিটি পোলে কিছু মেরামত করার জন্যে ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড থেকে জানিয়েছিল পুরো চব্বিশ ঘণ্টা ইলেক্ট্রিসিটি থাকবে না। সেদিন সকাল দশটা নাগাদ ইলেক্ট্রিসিটি গেল আর বারোটা নাগাদ চলে এল। তারপর থেকে সারাক্ষণ সকলে উৎকন্ঠায় কাটাতে লাগল যে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাইশ ঘণ্টা তো এখনো বাকি আছে। এই ইলেক্ট্রিসিটি এখন থাকবে তো নাকি আবার যাবে? রত্নাকরের এখন সেই রকম অবস্থা। বারবার মনে হতে লাগল। মল্লিকা সত্যি যাবে তো? কবে যাবে সে তো বলল না।
কিছু কথা খুঁজে না-পেয়ে রত্নাকর বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে কাল জানিও।’
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25