।। পনের ।।
রত্নাকর পরের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে জুঁইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে বার দুয়েক চা খেয়ে এলো। জুঁই তখনও এলো না। এটা ওটা করে সময় কাটাতে কাটাতে একসময় বেলা এগারোটা বেজে গেল। কয়েকবার ভাবল একবার ওদের বাড়ি যায়। কিন্তু কাল রাতের পরে আজ সকালেই আবার যাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে আর যেতে পারল না। যাব কি যাব না, কি করি, কি করি করতে করতে বেলা যখন বারোটা গড়িয়ে সাড়ে বারোটা বাজল, তখন রতন কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে কিছু খেয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরত আসতে লাগল। রত্নাকর বাসার যত কাছাকাছি আসতে থাকল, উৎকণ্ঠা তত বাড়তে লাগল এই ভেবে যে, এরমধ্যে জুঁই এসে ফেরত চলে যায় নি তো।
বাসায় পৌঁছে রত্নাকর চারিদিক দেখে যখন বুঝল জুঁই আসে নি, আবার অপেক্ষা করতে লাগল। একেকবার মনে হল, দরজার তালার সাথে একটা নোট লিখে রেখে কোথাও চলে যায়। সময়টা যেন আর কাটতে চায় না। একবার দুশ্চিন্তা হয় তো একবার রাগ হয়। ভাবল, এর থেকে একা থাকাই ভাল ছিল। এইভাবে বিরক্তি যখন ক্লান্তির পর্যায়ে পৌঁছালো, রত্নাকর তখন একটা চাদর টেনে বিছানায় শুয়ে পরল।
কিছুক্ষণের মধ্যে রত্নাকর ঘুমিয়ে পরল। কতক্ষণ পার হয়েছে কে জানে? দরজায় একটা খুট খুট শব্দে রত্নাকরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দেখে শম্পা।
কাঁচা ঘুম থেকে উঠে মাথা তখনও পরিষ্কার করে কাজ করা শুরু করে নি, ঘুম ভাঙ্গা চোখের দৃষ্টিও পুরোপুরি পরিষ্কার হয় নি। রত্নাকরের মনে যে কথাটা এসেছিল সেটাই বের হয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল, ‘এত দেরী করলে?’
শম্পা বলল, ‘তার মানে?’
একটা হাই তুলে ঘুমটা একটু কাটতেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেই চমকে উঠল। রত্নাকর দুই-পা পিছিয়ে সরে দাঁড়াল।
শম্পা ঘরের ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার? এই অবেলায় ঘুমচ্ছিলে এখন? শরীর ঠিক আছে তো?’
রত্নাকর তাড়াতাড়ি করে বিছানা টেনেটুনে ঠিক করে বলল, ‘বসো।’
বিস্ময়ে, উত্তেজনায়, আবেগে রত্নাকরের কথা বলতে পারল না। বুকের ভিতরে ধপ-ধপ করতে লাগল। ওর মনে হল, ও নিজের হার্ট-বিট নিজেই শুনতে পাচ্ছে। রত্নাকরের এইরকম অবস্থা দেখে শম্পা জিজ্ঞেস বলল, ‘আগে তুমি বসো। তোমার কি হয়েছে?’
‘আমার আবার কি আবার হবে?’ এই বলে রত্নাকর এক গ্লাস জল খেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জল খাবে?’
‘না।’
রত্নাকর জল খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে তুমি এসেছ। এখন কোত্থেকে এলে?’
শম্পা কিছুক্ষণ হাঁ-করে তাকিয়ে থাকল। তারপরে বলল, ‘আজ আমাকে তুমি তুমি করে বলছ। কি ব্যাপার?’
রত্নাকর বুঝল, জুঁইয়ের ঘোর ওর তখনও পুরোপুরি কাটে নি। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘কেন খারাপ কিছু করেছি? ‘তুমি’ শুনতে ভালো লাগছে না?’
‘এই কয়দিন দেখা না-হওয়ায় এই অবস্থা তোমার?’
ততক্ষণে রত্নাকর নিজের অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে পুরোপুরি সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। বুঝছে, এ শম্পা, জুঁই নয়। সারাদিন ধরে জুঁইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মাথার মধ্যে জুঁই এমনভাবে ঢুকে গেছে যে শম্পার সামনেও সেইরকম একটা ভাব বের হয়ে এসেছিল।
রত্নাকর জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘এটাকে তুই কয়দিন বলছিস? তোর চলে যাওয়ার পরে আমার যে কি ভাবে কেটেছে তা যদি জানতিস।’
‘জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।’ বলে শম্পা একটা শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমার চিঠি পেয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। তাতে তো কিছুই তেমন লিখিস নি।’
‘কি জানতে চাও? জিজ্ঞেস করো। এখন বলছি।’
রত্নাকরের মনে হল, শম্পাকে যেন আরও সুন্দরী দেখাচ্ছে। মনে পরল, যাকে খুঁজে বেড়াতাম রাতদিন-দিনরাত, নিজেকে হারিয়ে থাকতাম যার চিন্তায় এখন সে আমারই সামনে বসে আছে! যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হল, একটু ছুঁয়ে দেখি। হাত বাড়িয়েও টেনে নিল। মনে মনে নিজেকে বলল, এ কি পাগলামি হচ্ছে? আবার ভাবল, এই পাগলামিকে যদি প্রেম না বলি তো এটা কি?
শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘কি অমন হাঁ-করে দেখছ?’
‘কিছু না।’ রত্নাকর চোখ সরিয়ে নিল। রত্নাকর আবার বলল, ‘এক সময় এই দেওয়াল, দরজা, জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার সময় কেটে যেত এই ভেবে যে হঠাৎ করে তুই একদিন এসে পরবি। আর আমি তখন কি করব?’
‘কি করবে ভাবতে?’
‘ভাবতাম, তোকে জাপটে ধরে থাকব, কালো কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখব যাতে কেউ না দেখতে পায়। ভাবতাম, এবার আর অত প্ল্যান করে নয়, তুই এলেই তোকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।’
‘কই? সেই সবের একটা কিছুও তো করলে না।’
‘এখন মনে হচ্ছে তোর সামনে এইরকমভাবেই বসে থাকি।’
শম্পা জিজ্ঞেস করল, ‘আমি যদি এখান থেকে আর কোথাও না-যাই?’
‘তার মানে? তুই আবার কোথায় যাবি? এবার যেমন করেই হোক, তোকে আর যেতে দিচ্ছি না।’
শম্পা বিছানার একদম ভিতর দিকে সরে বসে বলল, ‘এখানে উঠে এসো।’
রত্নাকর এক লাফে বিছানায় উঠে ওর গা-সেঁটে বসল। শম্পা বলল, ‘এবার আমি সব মিটিয়ে এসেছি। ওরা আর জোর করে আমাকে নিতে আসবে না।’
‘বাঃ। কি করে করলি?’ পুরো ব্যাপারটা শোনার জন্যে রত্নাকর ঘুরে শম্পার মুখোমুখি হয়ে বসল।
শম্পা বলল, ‘Tit for tat বোঝ? এবার সেটাই করেছি।’
‘মানে?’
‘অন্যের উপর রেগে বা out of some furstration বা আহ্লাদে-আটখানায় অনেকে অনেক কিছু বলে ফেলে। লোকের টাকা হলে মেজাজের কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না। এদিক ওদিকে থেকে কিছু কিছু information আমার কাছে এসে গিয়েছিল। conspiracy-এর পুরোটা জানতাম না। আগে জানার চেষ্টাও করি নি। এইবার সেইগুলোকে জোড়া দিয়ে এদিক ওদিক থেকে আরও কিছু খবর জোগাড় করে ওদের বললাম আমার পেছনে যদি লাগ তো আমি সব ফাঁস করে দেব।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? প্রথমে আমাকে ভয় দেখালো। হয়ত মেরেও ফেলত। কিন্তু তার কয়েকদিন আগে আমি ওদেরই একজনকে দিয়ে তোমাকে লেখা চিঠিটা পোস্ট করিয়ে ছিলাম। আমি বললাম, আমার যদি কিছু হয় বা তুমি যদি আমার খবর ঠিক সময় মত না-পাও, তুমি ওই খবরগুলো ঠিক জায়গা মত পৌঁছে দেবে। ওরা বলল, তোমাকেও উড়িয়ে দেবে। তখন আমি বললাম, এত দিন আপনাদের সাথে থেকে কি এইটুকুও শিখি নি? বললাম, তোমারও দুটো backup রেখা আছে। তোমার কিছু হলে ওরা ফাঁস করে দেবে।’
‘বাপ রে! তারপর?’
‘তারপর সবাই লাইনে এলো। জিজ্ঞেস করল, আমি কি চাই? আমি বললাম, আমি আর ওদের সাথে বা কারুর সাথেই আর কাজ করব না। আমি এই কাজ ছেড়ে দেব। যতদিন ওরা আমাকে বা তোমাকে ঘাটাতে আসছে না, ততদিন সব ঠিকঠাক থাকবে। নইলে বিপদ।’
‘তুই তো dangerous!’ বলে রত্নাকর সোজা হয়ে বসল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আমি তো কোন খবরই জানি আর ওই চিঠিতে তো এসবের কিছুই নেই। তোর যদি কিছু হয়ে যেত!’
‘কিছু হয় নি তো? তবে এত চিন্তা করছ কেন? তোমাকে চিঠিতে এইসব জানালে কি করতে কি করে বসবে! তাই জানায় নি।’
‘আমার back up কে?’
‘কেউ না। তুমি তো কিছুই জান না। তোমার আবার backup চাই কেন?’
‘ওই লোকগুলো যদি জানতে পারে যে তোর এই backup বলতে কিছু নেই। তাহলে তো ওরা তোর পিছনে লাগবে।’
‘জানবে কি করে? আর সে জন্যেই তো নিজে না-করে ওদেরকে দিয়ে চিঠিটা পোস্ট করিয়েছিলাম। যাতে আমাকে সেটা প্রমাণ করতে না-হয়। এখন তুমি জানলে, তাই এই কথা বলতে পারছ। যদি না-জানতে তাহলে কি ভাবতে পারতে যে আমার ভয় আছে?’
‘তা খবরগুলো কি?’
‘একদিনেই সব শুনে নেবে?’ একটু থেমে শম্পা বলল, ‘এইসব কারণেই তোমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখি নি। তখন নিশ্চয়ই আমার উপরে খুব রাগ করেছিলে?’
রত্নাকর এবার মাথাটা পিছনের দেওয়ালে হেলিয়ে দিয়ে সোজা সামনে তাকিয়ে বসে থাকল। কিছুই বলল না। অনেক ঘটনা মনে পরতে লাগল। কিভাবে ওর খোঁজ করতে করতে দিনের পর দিন হয়রান হয়ে বাসায় ফিরেছে। কোন হদিস পায় নি। সারাদিন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে নিজেকে কিরকম অসহায় লাগত তখন। একেক সময়ে মনে হত ও যখন কোন সম্পর্কই রাখল না, কোন খোঁজ দিল না, তখন নিজেকে কেন প্রতারিত করব? মুখে বলল, ‘একদিন তোর চিঠি এল। একটা সান্ত্বনা পেলাম। কিন্তু ভিতরটা ছিঁড়ে-ফুঁড়ে গেল যে, এত কাছে এসেও একবার এখানে এলি না। শেষে তোকে চিঠি পাঠাতে হল?’
বাইরে তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। অথচ কেউ উঠে ঘরের আলোগুলো জ্বালায় নি। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। জানালা দিয়ে যে আলোটুকু ঘরে আসছে, তাতেই একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী মনে হতে লাগল। একটা আন্তরিক উষ্ণতা অনুভব করতে করতে একসময় শম্পা রত্নাকরের কাঁধের উপর মাথাটা রেখে বলল, ‘আমার উপরে নিশ্চয় তোমার অনেক নালিশ আছে? সব শুনব। আমার শুধু একটাই অনুরোধ।’
‘কি?’
‘আমার অক্ষমতা আর অপরাধকে যেন এক পাল্লায় মেপো না।’
রত্নাকরের ভিতর থেকে একটা গভীর শ্বাস বের হয়ে এল। রত্নাকর শম্পার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিল। এরপর অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না।
তারপরে একসময়ে বলল, ‘যার জন্য কোনদিন কিছু করি নি, যাকে কোনদিন কিছু দেই নি, তার উপরে কি রাগ করা যায়? আমি শুধু ভাবতাম, তোর নিশ্চয় বড় রকমের একটা কিছু হয়েছে। সেটা যে কিরকম? – তার কোন আন্দাজ করতে না-পেরে শুধু হতাশই হতাম। এখন মনে হচ্ছে একজনের জীবন কত কষ্টের হতে পারে হয়ত সেটা আন্দাজ করা অন্য কারুর পক্ষে হয়ত সম্ভব না।’
বাইরে দিনের শেষ আলো তখন মুছে গেছে। কারুর বাড়ি থেকে একটা শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল। এই ঘরের মধ্যে দুটো মানুষ কেউ কাউকে ছেড়ে একটুও উঠল না। শম্পা আরও নিবিড় হয়ে রত্নাকরের কাছে সরে এসে কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমার কষ্টটা কি সত্যি তুমি বুঝতে পারবে? যার জন্যে আমি মরতে পারি তাকে নিজের কাছে চাইতে পারি না।’ শুনে রত্নাকর শম্পাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড আবেগে ওর ঠোঁটে একটা জোরে চুমু খেল। তারপরে শম্পার মাথাটা ধরে কাছে আরো কাছে আনতে গিয়ে টের পেল শম্পার গাল দুটো ভেজা ভেজা। রত্নাকর বলল, ‘এবার লাইটা জ্বালাই।’
‘আরেকটু পরে।’
রত্নাকর উঠল না, যেরকম ভাবে বসে ছিল সেইরকম ভাবেই বসে থাকল। শম্পা রত্নাকরের বুকের মাঝখানে মাথাটা গুঁজে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পার হল এইভাবে। তারপরে শম্পা সোজা হয়ে বসে বলল, ‘শুনলে আশ্চর্য হবে। কারুর পক্ষে বিশ্বাস করাও অসম্ভব। তবু বলি। এই প্রথম কেউ আমার ঠোঁটে চুমু খেল।’
শুনে রত্নাকর ওকে আবার টেনে জড়িয়ে ধরল। শম্পা বলল, ‘এইটুকুই কেবল তোমার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।’
রত্নাকর শম্পার বাঁদিকের বুকের উপর হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আর এইটা?’
শম্পা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘সিনেমার অনেকগুলো ডায়ালগ আমার জানা আছে। সেগুলো বললে এই মুহূর্তটাকে আমাকে তোমার খুবই ভালো লাগবে। শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আমি কি তোমার কাছে এতটাই দুর্বোধ্য? জানতে যদি চাও তবে তোমাকে নিজের চেষ্টায় জেনে নিতে হবে। আমি বলব না।’
রত্নাকর শম্পার ঠোঁটের উপরে আরেকবার চুমু দিয়ে বলল, ‘এবার আলোটা জ্বালি।’
আলোটা জ্বালতেই দুজনের চোখদুটো একটু কুঁচকে এলো। আলোটা একটু চোখ সওয়া হতেই রত্নাকর দেখল, শম্পা একই রকমভাবে বসে আছে। আঁচলটা গেছে সরে অনেকখানি গায়ের উপর থেকে, আলুথালু চুল, খুশীর আভায় মুখখানি লাল। একটা তৃপ্তির অভিব্যক্তি। বিস্মৃত বেদনার আভাসটুকু গেছে মুছে। অর্ধেক খোলা চোখে তাকিয়ে আছে ও নিচের দিকে। ঠোঁটের লিপস্টিক ঘষে গেছে গালের এককোণে। রত্নাকরের মনে হল, যখন ছিলে না তুমি এই ঘরে তখনও ছিলে আমার মনে। আমি ভালোবেসেছি তোমাকে। তারই অতল গভীর থেকে স্নান করে উঠেছ তুমি। ঘুম থেকে উঠে যখন দেখলাম তোমাকে, আমি কি জানি সময়ের এই ছোট টুকরোকে এমনভাবে ভরিয়ে দেবে।
আলো জ্বেলে রত্নাকর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। শম্পা আস্তে আস্তে চোখ তুলল। দেখল, রত্নাকর এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শম্পা যে ওর দিকে দেখছে ওর কোন খেয়াল নেই। শাড়ির আঁচলটা টেনে ঠিক করে চুলগুলো টেনে খোঁপা করে বিছানা থেকে নেমে এসে রত্নাকরের সামনে দাঁড়াল। নিজের রুমালের একটা কোণ দিয়ে রত্নাকরের ঠোঁটের পাশটা মুছে দিয়ে বলল, ‘যাও, ভালো করে মুখটা ধুয়ে আসো। কেউ দেখলে কি বলবে?’
রত্নাকর চলে গেল। শম্পা বিছানা টেনেটুনে ঠিক করে রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাল তোমার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে না? রাতে কি খাবে?’
রত্নাকরের মনে পরল, ওর এত বড় প্রমোশনের কথা তো শম্পাকে বলাই হয় নি। বাথরুম থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসে শম্পাকে টেনে বসাল। বলল, ‘এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। তোকে বলাই হয় নি।’ ওর চলে যাওয়ার পর রেজিগনেশন লেটারটা ফেরত নিতে গিয়ে কোম্পানিতে কি হল, কিভাবে প্রোমোশন পেল একে একে সব বলল।
তারপরে বলল, ‘যার জন্যে এত কিছু পেলাম, তাকে জানাতেই পারলাম না এসবের কোন কিছু। ভাবতে পারিস, আমার কি রকম লাগছিল তখন।’
‘এই তো এখন বললে।’
‘উঃ, আমার যে কি ভালো লাগছে। চল, কোথাও থেকে খেয়ে আসি এখন।’
শম্পা উঠে দাঁড়াল। দেখল ওর রেখে যাওয়া সব কিছু রত্নাকর গুছিয়ে রেখেছে। বলল, ‘বাঃ আমার সব জিনিষ দেখছি যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছ।’
রত্নাকর বলল, ‘হয়ত সব নাও পেতে পারিস।’
কথাটা শম্পার কানে কেমন একটু বেসুরে ঠেকল। শম্পা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো, তারপরে ওর আগের সুটকেস খুলে দুয়েকটা জিনিষ নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
রত্নাকরের মনে নানান অসংলগ্ন ভাবনা ছোটো ছোটো ঘূর্ণির মত ঘুরে বেড়াতে লাগল। শম্পা বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল, রত্নাকর কেমন আনমনা হয়ে কিছু ভাবছে। বলল, ‘বাইরে খেতে যেতে হলে যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।’
রত্নাকর শম্পার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল, চেনা-অচেনার অস্পষ্টতায় ও যেন ফিরে গিয়েছে অন্য জন্মে। শম্পা যেন সৌন্দর্য তারিফ করার এক জীবন্ত মূর্তি।
শম্পা বলল, ‘আজ নাহয় রাতে আমার ওখানে থেকে যেও।’
রত্নাকর কিছু বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে দুজনে বের হয়ে গেল।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25