Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রবুহ্য (দ্বিতীয় পর্ব)

।। চোদ্দ ।।

দিন কয়েক পার হয়ে গেল। কেউ শম্পার বিষয় নিয়ে কোন কথা বলল না। রত্নাকর ভালো করে জানে যে মল্লিকা নিজে থেকে শম্পার বিষয়ে কোন কথা তুলবে না। জুঁইয়ের সাথেও বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি। সেদিন শনিবার। অফিস শেষ করে রত্নাকর মল্লিকাকে বলল, ‘অনেকদিন মাসিমার সাথে দেখা করা হয় নি। আজ ভাবছি তোমাদের বাড়ি হয়ে যাব।’

‘বেশ তো, চলো না। কেউ কি তোমাকে যেতে মানা করেছে?’ মল্লিকা একটা আবেগহীন স্বরে উত্তরটা দিল।

সেদিন অফিসের পরে মল্লিকার সাথে রত্নাকর ওদের বাড়ি গেল। সেখানে পৌঁছে মাসিমার চেহারা দেখে রত্নাকর বলল, ‘আপনার একি চেহারা হয়েছে? কি হয়েছে আপনার?’

‘তেমন কিছু না। কয়েকদিন হল একটু জ্বর হয়েছে।’

কতদিন ধরে জ্বর হয়েছে? ডাক্তার দেখিয়েছেন? ওষুধ খাচ্ছেন? ডাক্তার কি বলেছে? ইত্যাদি প্রশ্ন করে যখন রত্নাকর থামল, মল্লিকা বলল, ‘মায়ের আবার ডাক্তারে অনীহা। বলে সর্দি-জ্বর, এমনি সেরে যায়।’

রত্নাকর বলল, ‘এমনিতে সারুক আর ওমনিতে সারুক, আপনাকে ডাক্তার দেখাতেই হবে।’ এই বলে মিনিট-খানেক চুপ করে কি একটা ভেবে, ‘আমি একটু আসছি’, বলে একাই বের হয়ে পাড়ার মোড়ে ডাক্তারের চেম্বারে নাম লিখিয়ে এল।

তারপরে বলল, ‘পাড়ার মোড়ের ডাক্তারের কাছে আপনার নাম লিখিয়ে এলাম। আজ আপনাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে তারপরে আমি বাড়ি যাব।’ তারপর নিজের বাবা-মায়ের কথা বলল। বলল, ‘এই বয়েসে শরীর নিয়ে অবহেলা করার কি ফল হতে পারে, তা আমার থেকে ভালো করে কেউ দেখে নি।’

মল্লিকা বলল, ‘দেখো, তোমার কোথায় যদি কাজ হয়। আমাদের কথা তো শোনে না।’

রত্নাকর ঘড়ি দেখে বলল, ‘ডাক্তার আসতে এখনো ঘণ্টা খানেক দেরী আছে। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।’ তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘জুঁইকে দেখছি না যে।’

মল্লিকার মা বললেন, ‘ও কলেজে গেছে। তারপরে কোন এক বন্ধুর বাড়ি হয়ে আসবে। ফিরতে একটু দেরী হবে বলেছে। চলে আসবে এখুনি।’

মল্লিকা তখন তিন কাপ চা করে আর একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট নিয়ে রত্নাকরের সামনে রাখল। রত্নাকর এক কাপ চা তুলে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, জিজ্ঞেস করে জুঁইয়ের বন্ধুর বাড়ি কোথায়। মনে মনে ভাবল, জুঁই আবার ওর বাসায় যায় নি তো? উৎকণ্ঠায় কোন কথা বলতে পারল না। চায়ের কাপ নিয়ে চুপ করে চা খেতে লাগল। তিনজনে চুপচাপ চা খাচ্ছে, কোন কথা নেই। এদিকে রত্নাকরের মনের মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরছে। জুঁই যদি ওর বাড়ি যায় বা ওকে না-পেয়ে ওর জন্যে মোড়ের দোকানে অপেক্ষা করে। এদিকে ও কথা দিয়ে দিয়েছে যে ডাক্তার না-দেখিয়ে আজ বাড়ি যাবে না। এখন কি করেই বা বলে যে, মল্লিকা নাম তো লেখানোই আছে। তুমি মাসিমাকে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসো।

মাসিমা বললেন, ‘রত্নাকর তুমি কি এত ভাবছ বলো তো? এই ঠাণ্ডা-গরমে আমার এইরকম এক-আধটু সর্দি-জ্বর হয়। দিন পাঁচেকের মধ্যে আপনি সেরে যায়।’

কিছু বলার সুযোগ পেয়ে আর জুঁইয়ের চিন্তা থেকে বের হতে পেরে রত্নাকর একটা স্বস্তি পেল। বলল, ‘সে আমি জানি। তবুও সাবধানের মার নেই।’

মল্লিকা বলল, ‘মা আজ তোমার কাছে জব্দ হয়েছে। আমাদের কারুর কথা শোনে না।’

চা খাওয়া শেষ হল। তারপরে আরও কিছুক্ষণ কাটল। রত্নাকর বলল, ‘মাসিমা, এবার আপনি শাড়িটা বদলে নিন। ডাক্তার চেম্বারে আসার সময় হয়ে এলো। এবার যেতে হবে।’

উনি ঘর থেকে শাড়ি বদলে এলেন। রত্নাকর মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যাবে নাকি?’

‘না। তোমার কাছেই মা জব্দ থাকবে। আমি গেলেই মা নানান বাহানা শুরু করবে। তুমি নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসো। আমি বাড়িতে আছি।’

রত্নাকর মল্লিকার মাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।

ডাক্তার দেখে বলল, ‘এইরকম জ্বর এখন সবার হচ্ছে।’ দু-তিন দিনের মধ্যে না-সারলে আবার আসতে বলে, কয়েকটা সাধারণ ওষুধ আর একটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিল।

মল্লিকার মা নানান আপত্তি করা স্বত্বেও রত্নাকর ওষুধগুলো কিনে ওনাকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে।

দরজায় কলিং বেল বাজানো মাত্র জুঁই দরজা খুলে দিল। জুঁইকে দেখে রত্নাকরের মুখের উপর দিয়ে দীপ্তির একটা ঝলক এসেই ঢাকা পড়ে গেল। জুঁইয়ের চোখমুখ দিয়ে একটা চাপা হাসি খেলে গেল। সেটা আর কেউ না-দেখলেও জুঁইয়ের মায়ের নজর তা এড়ালো না। উনি বললেন, ‘তোমরা গল্প করো। আমি ঘরে গিয়ে এখন একটু শুই।’ এই বলে উনি সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন।

রত্নাকর ওষুধগুলো জুঁইকে দিয়ে বলল, ‘এতে সব লেখা আছে। ঠিক সময় মত যেন উনি খান।’

জুঁই বলল, ‘সে কিছু একটা হবে। আপনি মাকে রাজি করালেন কি করে? আমরা তো বলে বলে হয়রান। বসুন।’

রত্নাকর এদিক ওদিক তাকিয়ে মল্লিকা দেখতে পেল না। ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, জুঁই ওর বাসায় গিয়েছিল কিনা? অথচ কি করে জিজ্ঞেস করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। জুঁই ওষুধগুলো রেখে ওর সামনে এসে বসল। রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলে?’

জুঁই ফিক করে একটু হেসে, ‘ওকে আপনি চেনেন না’, বলে রত্নাকরের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হাসতে লাগল। জুঁই বেশ বুঝতে পারল, রত্নাকর কি জিজ্ঞেস করতে চাইছে। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘কাছেই থাকে। একদিন আপনার সাথে আলাপ করিয়ে দেব।’

জুঁই যে ওর বাসা অবধি গিয়ে ফিরে আসে নি এইটা জানতে পেরে রত্নাকরের মনটা হালকা হয়ে গেল। বুকের মধ্যে আটকে থাকা বাতাসটা একটা জোর নিঃশ্বাসে বের হয়ে এল। আর কোন কথা খুঁজে না-পেয়ে রত্নাকর বলল, ‘অনেকদিন তোমাদের বাড়িতে আসা হয় নি। আজ কাজের তেমন চাপ ছিল না, তাই ভাবলাম তোমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাই।’

‘তাই বুঝি?’

জুঁই খোঁচাটা কোন দিকে তাক করে মারল, সেটা বুঝতে না-পেরে রত্নাকর কথা ঘোরালো। বলল, ‘সে যাই হোক, এসে ভালোই করেছি। মাসিমার একটা ডাক্তার দেখানোর খুব দরকার ছিল।’

‘সেটা আপনি ভালো করেছেন। তবে আপনার এখানে আসার কারণ জানতে চেয়ে কেউ কি আপনার কাছে কৈফিয়ত চেয়েছে?’

সত্যি তো কেউ তো ওকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি, তাহলে হঠাৎ করে আগ বাড়িয়ে এটা বলতে গেল কেন? রত্নাকর একটু আগে যে স্বস্তিটা পেয়েছিল নিজের কথায় নিজে জড়িয়ে পরে এবার অন্য এক অস্বস্তিতে পরল। যে কথাটা আড়াল করার জন্য এই কথা বলল, সেইটাই সামনে এসে পরল। সহজ সত্যি কথা সাহস করে সময়মত বলে ফেলতে পারলে, অল্প লজ্জায় তার থেকে পার পাওয়া যায়। কিন্তু সেই লজ্জা এড়াবার জন্যে যে বাড়তি কথা বলতে হয় তাতে জটিলতা কেবলই বাড়ে। রত্নাকর ভাবল বলে, তোমার সাথে কয়েকদিন দেখা হয় নি, তাই এলাম।

রত্নাকর অনেক চেষ্টা করেও কথাটা বলতে পারল না। বলল, ‘কৈফিয়ত দিচ্ছি না। এমনি বললাম।’

‘ও আমি ভেবেছিলাম, আপনি আমার সাথে গল্প করতে এসেছেন।’

রত্নাকর বুঝল, এ মল্লিকা নয়। মনের কথা বের করে নিতে জুঁইয়ের জুড়ি পাওয়া অসম্ভব। যে কথাটা সহজে বললে, পরিবেশটা কত মজার হতে পারত, সেটাকে ঢেকে রাখতে গিয়ে কত রকম অস্বস্তির মধ্যে পরতে হল। ধরা পরে যাওয়ার একটা গ্লানি রত্নাকরকে ছেয়ে ফেলল।

পাশের ঘরে বা কাছাকাছি কোথাও মল্লিকা আছে। অন্য ঘরে রয়েছেন জুঁইয়ের মা। এই জায়গাটা একান্তে প্রেম করার মত তেমন উপযুক্ত নয় যে, জুঁইকে জাপটে ধরে বলবে, আমার মনের কথা জানলে কি করে? রত্নাকর যেমন দূরত্ব বজায় রেখে বসে ছিল তেমনই বসে থাকল। আর ভাবতে লাগল, এটা কি জুঁইয়ের অভিযোগ না অনুযোগ?

রত্নাকর ঘাড় ফিরিয়ে একবার জুঁইয়ের দিকে তাকাল। দেখল, জুঁই ওর উত্তরের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। রত্নাকর বলল, ‘সেটা কি তোমাকে বলে দিতে হবে?’

জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘গত দুই সপ্তাহ আসেন নি কেন? ব্যস্ত ছিলেন? না, শরীর খারাপ হয়েছিল?’

‘মল্লিকা বলেছে বুঝি?’ একটু থেমে বলল, ‘একদিন একটু হয়েছিল।’

‘কি শরীর, না মন?’

রত্নাকর চমকে উঠল। ভাবল, মল্লিকা কি ওকে সব বলে দিয়েছে? সেদিন বলার পরেই মনে হচ্ছিল অত কথা মল্লিকাকে না-বললেই হত। জিজ্ঞেস করল, ‘আমার শরীর খারাপ হয়েছিল, সেটা কে বলল?’

জুঁই মুখ ঘুরিয়ে নিল। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এখন আপনি আর ছোট নন। যা করবেন ভেবে চিন্তে করবেন।’

রত্নাকর বুঝল, মল্লিকা শম্পার চিঠি আসার কথা ওকে বলে দিয়েছে। বলল, ‘কাল এসো। অনেক কথা আছে।’

জুঁই বলল, ‘আমাকে তো বলতে আসেন নি। আপনি বলেছেন দিদিকে। এখন আমাকে বলতে চাইছেন কেন?’

‘এখানে নয়। কাল এসো, তখন বলব।’

এমন সময় মল্লিকা ঘরের দরজাটা একটু শব্দ করে বের হয়ে এলো। ওদের দিকে না-তাকিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। কথা বলতে বলতে রত্নাকর জুঁইয়ের একটু কাছে চলে গিয়েছিল। রত্নাকর একটু সরে বসল। দুজনেই চুপচাপ। মিনিট-খানেক পরে মল্লিকা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে রত্নাকরকে বলল, ‘আজ আর হোটেলে খেতে হবে না। রাতে এখান থেকে খেয়ে যেও।’

রত্নাকর বুঝে পেল না যে ওর এখন আর থাকাটা ঠিক হবে না উঠে যাওয়াটা ভাল হবে। জুঁইয়ের দিকে তাকাল। জুঁইও কোন রকম ইশারা করল না। মল্লিকা রত্নাকরের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর নিজের ঘরের দরজাটা একটু ঠেলে প্রায় বন্ধ করে দিল।

রত্নাকর বুঝল, মল্লিকা ওদের সম্পর্কের কথা জানে। জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি মল্লিকাকে বলে দিয়েছ?’

‘যা বলার তা আপনি বলেছেন। আমার জন্যে কি কিছু বাকি রেখেছেন?’

‘আমি কি বলেছি? এর মধ্যে শম্পার একটা চিঠি এসেছিল সেটাই শুধু বলেছি।’

‘কই আমাকে তো সে কথা বলেন নি!’

‘দেখা হলেই বলতাম। আর সেই জন্যেই তো কাল তোমাকে আসতে বলছি।’

‘তাই বুঝি? দেখা হলে বলতেন! কিন্তু বলার জন্যে একবার দেখা করতে আসতে পারলেন না?’

রত্নাকর ভাবল, ও মল্লিকাকে যতটা বোঝে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলার মত মেয়ে মল্লিকা নয়। তবে কি মল্লিকাকে বলেছে বলেই ওর রাগ। তারপরে ভাবল, মল্লিকা জুঁইকে কি বলেছে সেটা এখন বড় প্রশ্ন। ভাবার চেষ্টা করল যে সেদিন মল্লিকাকে কি কি বলেছে।

রত্নাকরকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জুঁই বলল, ‘শম্পা-দির চিঠির কথা জানতে চাই না। আপনার কথা জানতে চাই।’

‘আশ্চর্য, এতক্ষণ চিঠির কথা বলি নি বলে এত রাগ করলে। আর এখন বলছ চিঠির কথা জানতে চাও না!’

জুঁই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এই জন্যেই হয়ত আপনার উপরে আমি রাগ করতে পারি না। আপনার আমাকে বলার মত নিজের কোন কথা নেই?’

এমন সময় মল্লিকা আবার দরজাটা একটু শব্দ করে খুলে বের হয়ে এল। তারপরে খাবার টেবিলে জলের গ্লাসে জল ভরে রাখতে লাগল। সেই দেখে জুঁইও উঠে গেল সেখানে। সেই রাতে জুঁইয়ের বাড়িতে খেয়ে রত্নাকর যখন বের হল, জুঁই এসে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এল। বলল, ‘কাল সকালে যাব। সাবধানে যাবেন।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25