।। তেরো ।।
মল্লিকা তাড়াতাড়ি করে শুকনো ফুলটা যেখানে ছিল সেখানে রেখে দিয়ে টেবিলটা গুছিয়ে রেখে চেয়ারটা টেনে বসে পরল। আজ মল্লিকার জন্মদিন না, তবু লেখাটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন যে ফাঁকা ফাঁকা মনে হল। কি মনে হল, মল্লিকা ডায়েরিটা টেনে পাতা ওলটাতে লাগল।
সঞ্জীব তখন জুঁইকে পড়াতে আসত সন্ধ্যা বেলায়। পড়ানোর পরে মল্লিকার সাথে গল্প করতে করতে একদিন এই ডায়েরিটা টেনে লিখেছিল –
আমি কোনও এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোনও এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছ
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাব
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন
উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
মল্লিকা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কি তোমার লেখা?’
সঞ্জীব বলেছিল, ‘প্রেমটা চিরন্তন। সবাই সেইটা করে নিজের মতন করে, তা ব্যক্তিগত। এই কবিতাটা জীবনানন্দের লেখা। যেন আমারই কথা।’
শুনে মল্লিকা লাইনগুলো আরেকবার পড়ে বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারে নি। চুলের বিনুনি ঘাড়ের উপর দিয়ে সামনে টেনে আঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। সঞ্জীব আবার ডায়েরিটা টেনে এই লেখার ডান দিকের পাতায় আবার লিখেছিল –
হাড়ের চিরুনি দিয়ে তোমার মাথার থেকে খুলে
সব চুল টেনে দিও হৃদয়ের ‘পরে
ডেকে নিও সব ঘুম চোখের ভিতর
শিয়রে-পায়ের থেকে কাঠি রেখো তুলে।
সঞ্জীব লিখে ডায়েরিটা যখন ওর দিকে এগিয়ে দিল। মল্লিকা একবার পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কি তোমার লেখা?’
সঞ্জীব চোখ দুটো গোল গোল পাকিয়ে বলল, ‘না। এটাও জীবনানন্দের লেখা। আমি এইরকম লিখতে পারলে কি আর তোমার সাথে প্রেম করতাম?’
মল্লিকা বলেছিল, ‘সেই তো। তাহলে তোমার অনেক ফ্যান হত। অনেক মেয়েও জুটে যেত। তাদেরই কারুর সাথে প্রেম করতে।’
‘এই বুঝলে এতক্ষণে?’ – বলে সঞ্জীব ডায়েরিটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে একটু মুচকি হেসে বলেছিল, ‘না সোনা, এই রকম লিখতে পারলে আমি এই কবিতাগুলোর প্রেমে ডুবে থাকতাম।’
মল্লিকা ডায়েরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে এই পাতাটায় এসে থেমে গেল। এমন সময়ে কোত্থেকে একটা টিকটিকি মাটিতে পরেই পালিয়ে গেল। মল্লিকার মনে পরে গেল –
এখনকার মত তখনও মুখোমুখি দুটো ঘর। একটাতে জুঁই আর একটাতে মল্লিকা। সঞ্জীব জুঁইকে পড়াতে এলে মল্লিকা নিজের ঘরের পর্দাটা পুরো টেনে দিত। সঞ্জীব যখন জুঁইকে পড়িয়ে ওর ঘর থেকে বের হত, মল্লিকা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসত। সাধারণ ভদ্রতা মেনেই বলত, আজ হয়ে গেল? জুঁই কেমন পড়ছে? বলতে বলতে দরজা অবধি এগিয়ে দিত। সঞ্জীব জুতো পরে বার হয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে ফেরত আসত। সেখান থেকে একটু একটু করে কোনদিন নতুন সিনেমা, গানের নতুন সিডি-ক্যাসেট, কোনদিন বইমেলা, আনন্দ-পুরস্কার, কখনো বা হাল ফ্যাশন – এই অবধি। বন্ধুত্বের ভান করে গল্প করা, বা উপদেশ-পরামর্শ দেওয়ার অছিলায় কৌতূহলী প্রশ্নের জাল ছড়িয়ে বসত না।
একদিন মল্লিকা শুনল, সঞ্জীব জুঁইকে বলছে জানতো শিকারিরা চোখে দেখার থেকে গন্ধ আর শব্দের উপর বেশী নির্ভর করে। জুঁই জিজ্ঞেস করল, না দেখে কি করে শিকার ধরবে? সঞ্জীব বলল, যেটা চোখের সামনে আছে সেটা দেখা যায়, তাও যদি না কিছুর আড়াল হয়ে থাকে। শিকার যদি পেছন থেকে আসে বা রাতের অন্ধকারে আসে, তাহলে দেখবে কি করে? সে যদি পায়ে শব্দ না-করে চলতে পারে, তাহলে? তাই শিকারিরা গন্ধ আর শব্দের উপরে বেশী ভরসা করে। বন্দুক চালানোর সময় শুধু চোখের দরকার হয়।
সেদিন সঞ্জীবের পড়ানো হয়ে গেল। মল্লিকা বের হল না। তারপরের কয়েকদিন একই রকমভাবে কাটল। একদিন জুঁইকে পড়িয়ে সঞ্জীব মল্লিকার দরজায় দুটো টোকা মেরে বলল, ভিতরে আসতে পারি?
‘আসুন’ – বলে মল্লিকা উঠে দাঁড়াল। সঞ্জীব চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মল্লিকা বলল, বসুন।
সঞ্জীব বসল না। জিজ্ঞেস করল, ‘সব খবর ভালো তো? গত কয়েকদিন তোমাকে দেখলাম না।’
‘সব ভালো। তবে আমি শিকারি নই। সেদিন জুঁইকে ওইসব না-বললেই ভালো করতেন। ও ছোট মেয়ে, ওর সামনে ও সব কথা বলা ঠিক না। যদি কিছু বলার থাকে আমাকে সোজাসুজি বলতে পারতেন।’ মল্লিকা এক নিঃশ্বাসে বলে যখন থামল, সঞ্জীব ঠিক বুঝতে পারল না যে মল্লিকা কোন কথার উল্লেখ করছে। তবে এইটুকু বুঝল যে, গণ্ডগোল কিছু একটা হয়েছে। সঞ্জীব চেয়ারটা টেনে বসে বলল, ‘আগে তুমি বসো, তারপরে শুনছি তোমার কথা।’
মল্লিকা ধপ করে বিছানার একদিকে বসে মাথা ঘুরিয়ে থাকল। সঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের কথা বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ। মল্লিকা বলল, ‘কয়েকদিন আপনার ডিওড্রান্টের প্রশংসা করেছি, তাই আমাকে টিজ করে বললেন শিকারিরা গন্ধ আর শব্দের উপরে বেশী ভরসা করে। আমাকে কি ভাবেন? তারপরেও আশা করেন আমি আপনার সাথে কথা বলব।’
শুনে সঞ্জীব কনুইটা টেবিলে রেখে হাতের তালুর মধ্যে কপালটা গুঁজে, ‘হায় ভগবান’, বলে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপরে মাথা তুলে বলল, ‘তাই এই রাগ! জুঁইয়ের টেবিলে গিয়ে দেখো বইটা এখনো আছে সেখানে। সেদিন ওকে অঙ্ক করতে দিয়ে সামনের বইটা টেনে যে পাতাটার কোণা মোড়া ছিল সেটা পড়তে গিয়ে বুঝলাম, সে লেখক কোনদিন শিকার করতে যান নি, বা কোন ভাল শিকারির কাছ থেকে শিকারের ঘটনাবলিও শোনেন নি। তাই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে যতটা রোমাঞ্চকর করা যায় সেরকম একটা লিখেছে। জুঁই ছোট মেয়ে, আগ্রহ নিয়ে বইটা পড়ছে। লেখককে ছোট করতে চাই নি, তাই বলে ভুল ধারণা নিয়ে থাকবে সেটাও ঠিক না। সেই জন্যে ওইটুকু বলেছিলাম।’
মল্লিকা হা-করে সঞ্জীবের মুখের দিকে তাকিয়ে সঞ্জীবের কথাগুলো শুনছিল। সঞ্জীব যখন থামল, মল্লিকা মাথা নিচু করে বসে থাকল।
এমন সময়ে মল্লিকার মা বাড়িতে ফিরলেন। সঞ্জীবের জুতো দেখে বুঝলেন সঞ্জীব তখনও আছে। প্রথমে জুঁইয়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে তারপরে মল্লিকাকে বললেন, ‘কিরে ওকে এক কাপ চাও খাওয়াসনি এখনো?’
সঞ্জীবকে গত কয়েকদিন চা দেয় নি সেটা সঞ্জীব টের পেয়েছিল। এখন আসল ব্যাপারটা বুঝল। সঞ্জীব বলল, ‘না মাসিমা, আমি না-করেছিলাম। বিকালে বেশ কয়েক কাপ খাওয়া হয়ে গেছে।’ উনি চলে গেলেন নিজের ঘরে।
মল্লিকা মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি সরি।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি জানলেন কি করে? আপনি কি কখনো শিকার করেছেন?’
এমন সময়ে কোত্থেকে একটা টিকটিকি খপ করে মল্লিকার পাশে বিছানার উপরে পরে ফতফত করে দৌড়ে চলে গেল। আর মল্লিকা ভয় পেয়ে চোখ বুজে এক লাফে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে সোজা সঞ্জীবের কাঁধের উপরে গিয়ে পরল।
ভয়টা যখন কমল, মল্লিকা বুঝল, ও সঞ্জীবের উপর কাঁধের উপরে পুরো ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর সঞ্জীব ওর ভার সামলাতে ওর কোমরটা দুহাতে ধরে রেখেছে। মল্লিকা সঞ্জীবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সঞ্জীবও নিজের দুহাত সরিয়ে নিল। আর বলল, ‘ওটা একটা টিকটিকি ছিল। মনে হয় দেওয়াল থেকে পড়েছে।’
মল্লিকা বিছানার চারিপাশ দেখে অন্য এক কোনে গিয়ে বসল। সঞ্জীব বলল, ‘আমি কোনদিন শিকার করি নি, বইয়ে পড়েছি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি এবার সত্যি তোমার শিকার হয়ে যাব।’
‘সরি, বললাম তো।’
‘কোনটা? আমার সম্পর্কে বাজে কথা ভাবার জন্যে না আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরার জন্যে?’
‘দুটোই।’
‘প্রথমটা একসেপ্ট করলাম, দ্বিতীয়টা ভেবে দেখব।’
মল্লিকা ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিল। পাশের ঘরে জুঁইয়ের হাঁটাচলার শব্দ এল। মল্লিকা চুপ করে বসে থাকল। আর ভাবতে লাগল, সঞ্জীব আর রত্নাকরের মধ্যে কত পার্থক্য। একজন বুদ্ধিদীপ্ত যুবক, যার সান্নিধ্যে ভাবনার দরজা খুলে যায়। মনে হয় কত কি জানার আছে। জানার অস্থিরতায় সে নিজে যেমন ছুটে চলেছে, তার সাথে যারা থাকে তাদেরও টেনে নিয়ে যায়। তাকে যত চেনা যায়, মনে হয় ততই যেন অচেনা। তার প্রতি শ্রদ্ধা হয়, ভালবাসতে ইচ্ছে করে, আরও জানতে ইচ্ছে করে, কাছে পেতে মন চায়, পাশে থাকলে গর্ব হয়। একজন জলোচ্ছ্বাস, আরেকজন নিস্তরঙ্গ জলাধার। কোন উচ্ছ্বাস নেই, নিজের অস্তিত্বের জাহির নেই, দম্ভ নেই। অথচ যার সান্নিধ্যে পরিবেশটা উদ্বেগহীন শান্ত হয়ে যায়। যাকে নিয়ে লিখলে ডায়েরির পাঁচ পাতাও হবে না অথচ তার কথা মনে হলে মনটা ভরে যায়, সেটা আবেগে না অনুকম্পায় – তাও ঠিক বোঝা যায় না। এক মুহূর্তে তাকে কত কাছের মানুষ মনে হয়। মনে হয় যাকে সব কথা বলা যায়, অন্যজনের মত ভাবনা-চিন্তা করে বলতে হয় না।
জুঁই গেল বাথরুমে। ফেরার সময় বলে গেল, ‘দিদি শুয়ে পর। রাত হয়ে গেল।’
মল্লিকার অনুভূতির রেশটা কেটে গেল। এরপর দুজনেই যে যার ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে পরল। আর ভাবল, কার কাছে যাই এখন আমার ভালবাসার দাবি নিয়ে?
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25