।। বারো ।।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে সারাটা রাত কাটল রতনের। সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠে রতন চায়ের কাপ নিয়ে বসে খামের উপরে পোস্টঅফিসের সিলমোহরের ছাপ, তারিখ দেখে ক্যালেন্ডার মিলিয়ে নানা রকম হিসাব করতে করতে অনেক বেলা অবধি পার করে ফেলল। তখন রতনের অফিস যেতে ইচ্ছে করল না।
পরের দিন যখন অফিসে পৌঁছালো, রতনকে অনেকে জিজ্ঞেস করল, কাল অফিসে আসেন নি কেন? শরীর ঠিক আছে তো? এইরকম নানান প্রশ্ন। রতন, না এমনি; ওই আর কি; মাথাটা ধরেছিল; এইসব বলে সবাইকে কাটিয়ে দিল। সারাদিন পরে বিকাল বেলায় যখন অফিস অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে মল্লিকা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কাল কি হয়েছিল?’ রত্নাকর বলল, ‘কিছু না। এমনি অফিস আসতে ইচ্ছে করল না।’ মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘এর পরে আবার কবে ডুব দেবে?’ রত্নাকর কিছু না-ভেবেই বলল, ‘আবার ডুব দেব কেন?’ একটু হেসে মল্লিকা বলল, ‘কোন কারণ ছাড়াই যখন কাল অফিসে এলে না, তখন সেটা তো আবারও হতে পারে। তাই জানতে ইচ্ছে করল।’ রত্নাকর গম্ভীর ভাবে বলল, ‘জেনে কি হবে?’ মল্লিকা একইরকম স্বরে উত্তর দিল, ‘সেটা না-জানলে কি করে বলব?’
রত্নাকর পরিষ্কার বুঝল, একে বাজে কথা বলে কাটানো যাবে না। তখন বলল, ‘কাল বাসায় পৌঁছে শম্পার একটা চিঠি পেলাম।’ ‘ও, তাই নাকি?’ বলে মল্লিকা উত্তেজনায় রতনের হাতটা একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিল। তারপর আশপাশ একটু দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলেছে? ও এখন কোথায় আছে?’ ‘এখন কোথায় আছে তা জানিনা। তবে কয়েকদিন আগে কলকাতায় এসেছিল।’ এই বলে রত্নাকর চিঠির বিষয়টা একটু একটু করে মল্লিকাকে সব বলল। শুনে মল্লিকা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পার এই ব্যাপারটা তুমি কবে থেকে জানতে?’ রত্নাকর বলল, ‘ওর অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পরে যখন আমার কাছে ছিল তখনই বলেছিল। ওর মামা ওকে বিয়ে দেওয়ার নাম করে এনে বিক্রি করে দেয় আর তারপর একটু একটু করে আজ ও এই অবস্থায়।’ শুনে মল্লিকা আবার কি ভাবতে লাগল আর দুজনেই চুপ করে বসে থাকল। ওদের ওরকমভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখে অফিসে যে কয়েকজন ছিল তারাও নিজেদের সময় মত কোন কথা না-বলে চুপচাপ বের হয়ে গেল। মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পা কবে আসবে বলেছে?’ ‘ঠিক করে কিছু বলে নি। লিখেছে কয়েক সপ্তাহ পরে।’ ‘তারপর?’ ‘তারপর কি – সে আমি নিজেও জানি না।’
মল্লিকা ‘হুঃ’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আজ উঠি। তুমিও এখন সোজা বাড়ি চলে যাও।’
রত্নাকর কিছু না-ভেবেই বলল, ‘আমিও তাই ভাবছি।’ মল্লিকা আর কথা না-বাড়িয়ে নিজের টেবিলে চলে গেল। তারপর ফাইল-পত্র গুছিয়ে ‘চলি’ বলে বের হয়ে গেল।
রত্নাকর তখনও একমনে শম্পার কথা ভাবছিল। মল্লিকার চলে যাওয়াতে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল। মনে মনে আশা করেছিল যে মল্লিকা টেবিল গুছিয়ে ওকে ওর সাথে যেতে বলবে। মল্লিকা যে এভাবে একা চলে যাবে সেটা ভাবে নি।
রত্নাকরের মনে হল, এত কথা হয়ত মল্লিকাকে না-বললেই ভাল হত। কি বুঝতে কি বুঝে বসল – কে জানে? তারপরে মনে হল মল্লিকা কি ভাবল তা নিয়ে ওর কি যায় আসে?
চিন্তাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা ফাইল খুলে সেই দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করল রত্নাকর। চোখ থাকল ফাইলের দিকে কিন্তু মন চলে গেল মল্লিকার কথাবার্তায়। মেয়েরা কখন যে অভিমান করে আর কিসে যে রেগে যায় রত্নাকর বুঝে উঠতে পারল না। রত্নাকরের মনে হল মল্লিকা যদি অফিসের সবাইকে বলে দেয়। কনিকাদির মত দু-একজনকে বললেই তো সেখানে সবাইকে বলা হয়ে যায়। জনে জনে সকলকে ডেকে বলতে হবে না।
এদিকে রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মল্লিকা ভাবতে থাকল যে, একখানা চিঠি পেয়েই যদি এই অবস্থা হয়, শম্পা একবার সামনে এলে রত্নাকরের কি অবস্থা হবে? শম্পার জন্যে রত্নাকরের সত্যি এত টান নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে? একটা সহানুভূতির আবেগ আচ্ছন্ন করে ফেলল মল্লিকাকে। বাড়িতে পৌঁছে জুঁইকে বলল শম্পার চিঠির কথা। জুঁই প্রথমে একটু চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ সব শুনল। কোন প্রশ্ন করল না।
জুঁইকে চুপ করে থাকতে দেখে মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে তোর কিছু মনে হল না?’
জুঁই বলল, ‘কি আবার মনে হবে?’
মল্লিকা বলল, ‘বাঃ রে, এই রকম একজন মেয়ের জন্যে কারুর এত টান? আর তোর কিছু মনে হল না?’
জুঁই বলল, ‘আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস? যার টান তাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন?’ এই বলে জুঁই উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।
তার কিছুক্ষণ পরে মল্লিকা জুঁইয়ের ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল, জুঁই জানালার ধারে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মল্লিকা আস্তে আস্তে হেঁটে জুঁইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর পিঠের উপরে হাতটা রাখতেই জুঁই ‘দিদি’ বলে মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
মল্লিকা জুঁইয়ের মাথার উপরে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘কিছু ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
জুঁই নিজেকে সামলে নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। মল্লিকাও জুঁইয়ের পিছন পিছন এসে ওর পাশে বসল। জুঁই বলল, ‘দিদি তুই যেদিন সঞ্জীবদার সাথে ঝগড়া করে এসেছিলি আমিও তোকে বলেছিলাম, ‘কিছু ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আজও তো কিছুই ঠিক হল না।’
মল্লিকা বলল, ‘তুই তো রত্নাকরের সাথে ঝগড়া করে আসিস নি।’ তারপরে অনেকক্ষণ দুজনে আর কোন কথা বলতে পারল না।
জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘শম্পাদি কবে ফেরত আসবে রত্নাকরদা কিছু বলেছে?’
মল্লিকা বলল, ‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও ঠিক করে কিছু বলতে পারল না।’
জুঁই জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কি মনে হয়?’
‘জানি না।’ – বলে মল্লিকা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
জুঁই এমন ভাবে সঞ্জীবের প্রসঙ্গটা তুলে আনল যে মনটা ভার হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে টেবিলের উপর রাখা কিছু বই খাতা ডায়েরি টেনে আবার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ভিতর থেকে একটা শুকনো ফুল টুক করে মেঝের উপর পরল। গোলাপ কিম্বা অন্য কোন কিছু হবে। একদিন ছিল টকটকে লাল, কিম্বা গোলাপি রঙের। এখন সেটা শুকনো কালো ফুল। দ্যুতি গেছে তার কবেই চলে, আবেশ মাখানো গন্ধ এখন নেই। তবু আলতো করে তুলে মল্লিকা একবার শুঁকে ভাবল এই আমার প্রথম প্রেমের ধ্বংসাবশেষ।
ডায়েরির পাতাটা খুলে দেখল, রসের ছাপ শুকিয়ে অবিন্যস্ত আঁকাবাঁকা রেখায় সেটা নিজের একটা প্রতীকচিহ্ন করে রেখেছে এই শুকনো ফুল, গোলাপ কিম্বা অন্য কিছু হবে। হঠাৎ নজর গেল লেখার উপর।
লেখা আছে –
মনে রেখো আজ তোমার জন্মদিনে।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25