।। এগার ।।
এর পরে আরও আরও কয়েকমাস পার হয়ে গেছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে রতন দরজা খুলে দেখে মেঝের মধ্যে একখানা চিঠি পরে আছে। এই বাড়িতে এর আগে ওর কাছে কেউ চিঠি পাঠিয়েছে বলে রতনের মনে পড়ল না। কাঁধ থেকে অফিসের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে চিঠিটা খুলে দেখে সেটা শম্পা পাঠিয়েছে। রতন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অনেকক্ষণ নামটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপরে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
রতন দা,
আমি জানি না তুমি কেমন আছ? কি ভাবছ? কয়েকদিন আগে আমার ফ্লাটে গিয়েছিলাম। পরিমলের (যে গার্ডটাকে তুমি মাঝে মাঝ ফোন করো) কাছে শুনলাম তুমি অনেকবার এসেছিলে। ওখানে ওই একমাত্র ভালো ছেলে বলতে পারো। আমার মনে হয় ও আমার কাজের ব্যাপারটা জানে, তবে আমাকে কোনদিন খারাপ চোখে দেখে নি। অন্তত আমার কখনো তা মনে হয় নি। কি জানি, কেন? হয়ত ওর কোন কারণ আছে, যার জন্যে ও আমার দুঃখটা বোঝে। যাহোক, পরিমলের গুণগান গাইবার জন্য এই চিঠি লিখছি না। শুধু এই কারণে বললাম যে, তুমি যখন প্রথম এসেছিলে আমার সুটকেস নিয়ে যেতে তখন যদি ওর সাথে দেখা হত তাহলে হয়ত কেউ জানতে পারত না। আমরা এই চক্রবুহ্য থেকে বের হয়ে পালিয়ে যেতে পারতাম। কি হলে কি হতে পারত সে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অভ্যেস আমার অনেক বছর আগে চলে গেছে। এখন শুধু ভাবি কাল কি করব। তবু এটা না-জানিয়ে পারলাম না। কেন জানো?
একসময়ে ভাবতাম, আমাকে এইভাবেই জীবনটা কাটাতে হবে। তোমার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পরে তোমার ব্যবহারে মনে হয়েছিল, তুমি হয়ত আমাকে ভালোবাসো। তুমি সেই আগের মতই চুপচাপ থাক, তবে আমার সব জেনেও আমাকে ভালবাসতে পারো – সে ইচ্ছে আর সাহস তোমার আছে। আরও একটা কারণ ছিল, যখন শুনলাম তুমি একা, বুঝলাম তোমাকে পেছনে টানার কেউ নেই। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের চাপ নেই। তাই তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আর কোন বাঁধা থাকবে না। সেটা আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা না লোভ – জানি না। তুমি বলতে পারবে।
আমার জীবনে যা যা হয়েছে তার জন্যে আমি কাউকে দোষী ভাবি না, একমাত্র ওই মামা (কয়েকটা বাজে কথা মুখে আসছিল, তোমার সামনে বলতে লজ্জা করল। তাই সেগুলো কেটে দিলাম) ছাড়া। বুঝি, সকলের কিছু অক্ষমতা থাকে, সীমাবদ্ধতা থাকে – সে আমার বাবা-মা হোক, আর তুমি হও। এমনকি আমারও আছে। লোকে যাকে কপাল বলে, কর্মফল বলে – সেগুলো মানতে পারি না। কারণ, সেরকম কোন কর্ম করলাম কখন? তার আগেই তো আমাকে ধরে বেঁধে এই খোঁয়াড়ের মধ্যে ফেলে দিল। এখন কানা গরুর মত অন্য লোকের তেল পিষে যাচ্ছি। কেন বলতে পারো? আমার কি একজন সাধারণ মেয়ের মত বাঁচার কোন আধিকার নেই?
পরিমলের কাছে সব শুনলাম। তাই ভাবলাম, তোমার কাছে একটা ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। জানো, তোমার কাছ থেকে চলে আসার পরে আমি কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। ভাবলাম, আত্মহত্যা করি। অনেককে করতে দেখেছি। তারপরে ওদের কথা ভেবে সেটা আর করতে পারলাম না। ভাবলাম, তাহলে তো সব শেষ হয়ে গেল। তবুও দুইবার সেরকম পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্ত শেষ অবধি সে দিকে যাই নি। কে জানে, হয়ত তোমাকে এই চিঠিটা লেখা হয় নি বলে। তুমি যেন এই চিঠিটা নিয়ে পুলিশের কাছে যেও না আবার।
এবার বলি তার পরের কথা। তোমার কাছ থেকে চলে আসার পরে আন্দাজ করতে পারো আমার এজেন্সি সেই রাতে আমাকে কোথায় পাঠিয়েছিল? দিল্লী। ওইখানেই আমরা পালানোর কথা ভাবছিলাম। মনে পরে? আমি ভাবলাম, এখানে এসেও আমি পার পেতাম না। তাহলে যাই কোথায়? ভেবে কোন কূলকিনারা করতে না-পেরে তোমাকেও কিছু জানাতে পারি নি। কি জানাবো তোমাকে? আমি দিল্লীতে আছি, তুমি কোন চিন্তা করো না – এই?
আর একটা কথা স্বীকার করি। ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে ভুলে যাবে। একবার সুখের মুখ দেখলেই লোকে যেমন নিজের অন্ধকার দিনগুলো, দুঃখের দিনগুলো তাড়াতাড়ি ভুলে যায়, তুমিও হয়ত ভুলে যাবে। জানতো নিশ্চয়, লোকে বলে শুভ কাজে আমাদের ছোঁয়া নাকি পয়মন্ত। কত লোক আসে আমার ঘর থেকে জল নিয়ে যায়, সেটা তাদের বাড়ির চারিদিকে ছিটিয়ে দেয় এই ভেবে যে সেই জলের বাষ্প নাকি সকলের বাজে নজর আটকে দেবে, তাদের বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। পুজার সময়ে আমাদের কাছ থেকে মাটি নিয়ে যায়। কি জানি তাতে ভালো কিছু হয় নাকি। তাদের সৌভাগ্য নিয়ে আসে নাকি। সে নিয়ে আগে কোনদিন ভাবি নি। তবে ভেবেছিলাম তোমার কাছ থেকে চলে আসার পরে। ভাবলাম, এর কিছুও যদি সত্যি হয় তার সবটাই যেন তুমি একা পাও। তোমার বাড়িতে ছিলাম – মাটি বলো, জল বলো, আমার পরা কাপড় বলো – সবই তো তোমার ওই ঘরে ছেড়ে এসেছি। তার জোড়ে যদি কিছু মাত্র ভালো হয় পুরোটাই তোমার ভালো হোক। তাই ভেবেছিলাম, হয়ত তোমার সুদিন এসেছে আর তুমি আমাকে ভুলে গেছ, বা তুমি এতো ব্যস্ত যে আমাকে মনে করার সময় পাও না। জানো তো আমিও কিন্তু স্বার্থপর। তোমার ওখান থেকে আসার পরে এই কথাটা মনে হওয়ার পর থেকে আমি আর কাউকে জল, মাটি, আমার পরা কাপড় দেই না। ঠিক করেছি, সব শুধু তোমাকেই দেব। একটা মেয়ে কত কি ভাবে তার স্বামীকে এই দেবে, সেই দেবে। এ ছাড়া আমার আর কি বা দেওয়ার মত আছে?
পরিমলের কাছে যখন শুনলাম তুমি অনেকবার এসেছো আমার খোঁজে আর বারবার ওকে ফোন করো, নিজেকে কি ছোট মনে হচ্ছে যে বলার নেই। আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। আর পরিমলকে ফোন করতে হবে না। আমাকে আবার বাইরে যেতে হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমি ফিরে আসব। তখন বাকি সব বলব।
ইতি
শম্পা (আমার এই নামটা লিখতে কেমন যেন গা ছমছম করে, অভ্যেস চলে গেছে কিনা)।
চিঠিটা পড়ে রতন বুকের উপর চিঠিটা চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। তারপর শুয়ে শুয়ে আরেকবার চিঠিখানা পড়ল। ঘরের কোনে তখনো শম্পার একখানা সুটকেস পরে আছে। তার ভিতর থেকে শম্পার একখানা কাপড় বের করে সেটাকে জড়িয়ে ধরল। আর ভাবতে থাকল, এই সব বিশ্বাসের কি কোন মুল্য নেই? এক এক করে ওর জীবনের ঘটনাগুলো মনে হতে লাগল।
শম্পা এলো। ওর ধার শোধ করে দিল। কিন্তু তার পরের ঘটনাগুলো? যে চাকরী ও ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু ফেরতই পেল না, না-চাইতে একেবারে দুই ধাপ প্রোমোশন। সব এমনি এমনি হয়ে গেল? শম্পা পয়মন্ত বলতে পয়মন্ত? সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। রতনের মনে হল, হাউ হাউ করে কাঁদতে পারলে বুকটা একটু হালকা হত।
তখনই মনে হল, পরিমল তো রাতে ডিউটি করে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ওকে ফোন করা হয় নি। পরিমল হয়ত শম্পার আরও কোন খবর দিতে পারবে। রতন সঙ্গে সঙ্গে বের হল মোড়ের দোকানে থেকে পরিমলকে একটা ফোন করার জন্যে।
ফোনে পরিমলকে পেয়ে রতন জিজ্ঞেস করতেই পরিমল বলল, ‘গত সপ্তাহে ম্যাডাম এসেছিলেন। আপনার কথা বলাতে আমাকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব কথা গোঁড়া থেকে জিজ্ঞেস করলেন। তারপরে ম্যাডাম বললেন উনি আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেবেন। আপনি তো আমাকে কোন ফোন নম্বর দেন নি যে আমি আপনাকে জানাব। তার দুদিন পরে ম্যাডাম চলে গেলেন।’ রতন জিজ্ঞেস করল, ‘যাওয়ার সময় ম্যাডাম কিছু বলেছিল?’ পরিমল বলল, ‘না তো।’ এইটুকু শুনে রতন সন্তুষ্ট হল না। জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম যাওয়ার সময়ে তুমি ছিলে সেখানে?’ পরিমল বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ছিলাম। আমি ওনার সুটকেস নামিয়ে দিলাম। ট্যাক্সিতে তুলে দিলাম। ম্যাডাম কিছু বলেন নি।’ রতন বলল, ‘ঠিক আছে।’ পরিমল জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম আবার এলে কিছু বলতে হবে?’ ‘না।’ এই বলে রতন ফোনটা কেটে দিল।
রতন ভাবতে লাগল, শম্পা দুই দিন কলকাতায় ছিল। সব জানতে পেরেও ও একবারও দেখা করতে এলো না। ভাবতে ভাবতে রতন একটা হোটেলে ঢুকে পড়ল। সেখানে অল্প কিছু খেয়ে বাড়ি ফেরত এলো। বাড়িতে এসে শম্পার ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো এক এক করে বের করে দেখতে থাকল। তারপরে সব ভালো করে গুছিয়ে রেখে চিঠিটা আর একবার পড়ে শুয়ে পরল।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25