Home » প্রবন্ধ » অমিত গুপ্তের মৃত্যুতে

অমিত গুপ্তের মৃত্যুতে

এ আমার দুর্ভাগ্য যে আজ আমি আপনাদের মধ্যে উপস্থিত থেকে এই রকম একজন ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না। সাংসারিক দায়িত্ব এমন বাঁধা হয়ে দাঁড়াল যে দূর থেকেই এই কাজ সারতে হচ্ছে। সাংসারিক সম্পর্কে শ্রী অমিত গুপ্ত মহাশয় আমার শ্বশুর-মশায় হন। বাঙালী সমাজে শ্বশুর এবং জামায়ের মধ্যে যে একটা অনুরক্তি থাকে আমার সাথে তাঁর মিশুকতা এবং অন্তরঙ্গতা ছিল আরও বেশী সুগ্রাহী।

জীবিকার কারণে আমি চরৈবেতি। এদেশ ওদেশ ঘুরে এখন অনেক দূরের এক দেশে গিয়ে ঠেক গেড়েছি। তাই আমার কাছে ওনার সাহচর্য এবং সান্নিধ্যের পরিমাণ নিয়ে আমার একটা অতৃপ্তি থেকেই গেল। আবার ভাবি, যা পেয়েছি, তার কি মূল্যায়ন করতে পরেছি? এ তো অর্থ-সম্পদ না, যে কিছুটা খরচ করে ভোগবিলাস করলাম আর বাকিটা ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখলাম। “রসতৃপ্তির প্রমাণ ভরাপেট দিয়ে নয় আনন্দিত রসনা দিয়ে, নতুন মাল বোঝাই দিয়ে নয়, সুখস্বাদের চিরন্তনত্ব দিয়ে।” তাই যা পেয়েছি তাই অনেক। তার থেকে দু-এক কথা বলব।

অনেকে বলেন অমিত গুপ্ত শিক্ষক ছিলেন। আমি ভাবি, তিনি চিরকাল ছাত্রই ছিলেন, শিক্ষাদাতা হন নি কোনদিন। কয়েকটা উদাহরণ দেই এই প্রসঙ্গে।

মালদা শহরের পোস্ট-অফিস মোড়ের মত আটলান্টা শহরে একটা জায়গা আছে – সেখানে নানান দিক থেকে বহু রাস্তা এসে জড়ো হয়েছে। তবে এখন সেখানে আর সাধারণ রাস্তা নেই। অনেকগুলো বহুতল ফ্লাইওভার নানান দিক থেকে এসে আবার নানান দিকে চলে গেছে। কোনটা একে অপরের সাথে মিশেছে, কোনটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে; আবার কোনটা সরাসরি একদিক থেকে এসে অন্যদিকে চলে গেছে। এই বহুতল ফ্লাইওভারটাকে হেলিকপ্টার থেকে দেখলে অনেকটা প্লেটে সাজানো স্প্যাগেটির মত মনে হয়। তাই সেই জায়গার নাম হল স্প্যাগেটি জংশন। একদিন উনি আমাকে বললেন, আমাকে একবার স্প্যাগেটি জংশনটা দেখাতে নিয়ে যাবে? সে শুনে একদিন ওনাকে নিয়ে গাড়ি করে সেই ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ঘুরে এলাম। পরেরদিন জিজ্ঞেস করলাম, কেমন দেখলেন? উনি বললেন, ঐ জায়গাটি আটলান্টার একটা বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান। আমি মনে মনে ভাবলাম, বড় বড় রাস্তা আর ফ্লাইওভার ছাড়া তো আমি আর কিছুই দেখি নি ওখানে, এরমধ্যে কি এমন ইতিহাস থাকতে পারে? মানলাম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দিক থেকে এটা  একটা উন্নত মানের কাজ, তা’বলে এ এমন কিছু না যা তাকে ঐতিহাসিক করে তুলতে পারে। উনি একটু মৃদু হেসে বললেন, ওইখানে আটলান্টায় প্রথম মুদির দোকান তৈরি হয়েছিল। বললেন, সেটা কে বানিয়েছিল, কোথা থেকে কাঠ কেটে এনে সেটা বানানো হয়েছিল। সেখানে কি কি বিক্রি হত? তারপর সে দোকানের কি হয়েছিল? এবং কিভাবে সেটা আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর যা হয়, আর কি। সর্ষের বস্তায় একটু ফুটো করে দিলে যেমনটি হয় – ঝুরঝুর করে পড়তেই থাকে যতক্ষণ না সবটি শেষ হচ্ছে। আমি তখন পাঁচ বছর এই শহরে থেকেও যা জানতে পারি নি, ওনার কাছে কয়েক ঘন্টায় জানলাম। গল্প করতে করতে বেলা হয়ে গেল। ভিতর থেকে ডাক এলো দুপুরের খওয়ার জন্যে। আমার কৌতূহল, উনি এইসব জানলেন কোত্থেকে? খেতে বসে সেকথা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরটা এলো আমার শাশুড়ির কাছ থেকে। বললেন, কয়দিন আগে এখানকার লাইব্রেরি থেকে ডজন-খানেক বই নিয়ে আসা হয়েছে। বাকিটা সহজেই অনুমেয়। তাই তখন খাবারের দিকে মন দিলাম।

তিনি যা জানতেন তাই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন। এইটাকেই হয়ত অনেক সময় শিক্ষকতা বলে ভুল হয়।

একবার আমরা গিয়েছিলাম NASA-র কেনেডি স্পেস সেন্টারে। সেখানে নানান জিনিষ দেখলাম, IMAX থিয়েটারে দেখলাম স্পেস সেন্টারে মানুষ কিভাবে থাকে, কি করে, কিভাবে সেখানে তাঁদের কাজ করে। তারপরে বর্তমানে পরিত্যক্ত হলেও যে স্পেস ক্রাফটটা একসময়ে সত্যি মহাকাশ পাড়ি দিত তার ভিতরে ঢুকলাম, দেখলাম। সেইটা ঘুরে এলাম কন্ট্রোল রুম দেখতে। সেখানে ঢুকে উনি বললেন, এই হচ্ছে আমার তীর্থস্থান। ভাবলেই আমার মধ্যে একটা thrill হচ্ছে যে, যেখান দিয়ে একসময়ে নিল আর্মস্ট্রং রোজ হেঁটে গেছেন, যেখান দিয়ে তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা হেঁটে গিয়ে রকেটে চড়েছে সেইখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভাবা যায়! এই হচ্ছে মানুষের তীর্থস্থান। এই বলে, বুক ফুলিয়ে একবার জোরে শ্বাস নিলেন, যেন বাতাসের থেকে কিছুর গন্ধ শুঁকছেন। সেখান থেকে ফেরত আসার সময়ে উনি আমাদের বললেন, কেন ফ্লোরিডা থেকে রকেট ছোঁড়া হয়। বললেন, রকেট যে চাপ দিয়ে উপরে ওঠে, সেটা সহ্য করার মত মাটির অবস্থা পৃথিবীর সব জায়গায় নেই। সেই থেকে শুরু হল ভূতত্ত্ব এবং ভূবিদ্যা নিয়ে আলোচনা। অনেকটা রাস্তা কাটল সেই নিয়ে। এবার অবশ্য বোকার মত জিজ্ঞেস করি নি যে, কোত্থেকে জানলেন এতসব।

একবার গিয়েছিলাম নিউইয়র্কে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে। তার পাশেই হচ্ছে এলিশ আইল্যান্ড। অনেক কাল আগে বিদেশ থেকে লোকজন জাহাজে করে আমেরিকায় আসত আর তাদের এইখানে নামতে হত। এটা ছিল তখনকার আমেরিকার অন্যতম পোর্ট অফ এন্ট্রি, বিশেষ করে যারা ইউরোপ দেশগুলো থেকে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের দিয়ে আমেরিকায় আসত। সেইখানে এখনও সেই রেজিস্টার রাখা আছে। আর তার পাশে কম্পিউটারে নাম টাইপ করে কে কবে এসেছিল তার খোঁজ করা যায়, তাঁদের সই দেখা যায়। সেইখানে গিয়ে উনি আমাকে চারটি নাম দিয়ে বললেন, দেখতো এখানে এঁদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাকি? তারপরে বললেন, যতদূর জানা যায় মালদহের এই চারজন ব্যক্তি প্রথম আমেরিকায় আসে। তাঁদের মধ্যে একজনের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। বাকি তিনজন বিভিন্ন সময়ে দেশে ফিরে আসে। এইটুকু মাত্র জানা যায়। এদের মধ্যে একজন মালদায় ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন আর অন্য দুজনের তেমন কোন খবর পাওয়া যায় নি। উনি বললেন, এঁরা তখন কি করেছিলেন, কি দেখেছিলেন, পরেই বা তাঁরা কি করলেন আমার জানার খুব ইচ্ছে। ইতিহাসের প্রতি, বিশেষ করে মালদার ইতিহাসের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ তাঁর মনকে সব সময় তাড়না করে বেড়াত। তা না হলে, আমেরিকায় নিউইয়র্কের মত জায়গা, যেখানে চারিদিকে চোখ ধাঁধানো জিনিষ ছড়ানো, সেখানে এসে উনি পড়লেন কি না মালদা থেকে প্রথম কে আমেরিকায় এসেছিলেন, তাঁরা কি করেছিলেন, তা নিয়ে। এঁকে ইতিহাসের অনুগত ছাত্র বলব, না শিক্ষক বলব?

সেই খোঁজের শেষ হয় নি সেখানে, তবে সে নিয়ে এখানে আর এগোব না। আসি অন্য প্রসঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ নিজের আত্মপরিচয়ে এক জায়গায় লিখেছিলেন, “অন্যান্য সেবকদের মতো সাহিত্যসেবক কবিদেরও খোরাকি এবং বেতন এই দুই রকমের প্রাপ্য আছে। তাঁরা প্রতিদিনের ক্ষুধা মিটাইবার মতো কিছু কিছু যশের খোরাকি প্রত্যাশা করিয়া থাকেন–নিতান্তই উপবাসে দিন চলে না। কিন্তু এমন কবিও আছেন তাঁহাদের আপ-খোরাকি বন্দোবস্ত–তাঁহারা নিজের আনন্দ হইতে নিজের খোরাক জোগাইয়া থাকেন, গৃহস্থ তাঁহাদিগকে একমুঠা মুড়িমুড়কিও দেয় না!” শ্রী অমিত গুপ্ত ছিলেন এই আপ-খোরাকির দলে। একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, অর্ডারি লেখায় আমার কোন রুচি নেই, তাতে নামি পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হবে না, এ আমি জানি। তা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। শুনে মনে হল, রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি শুনলাম যেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিকর্তা। মানুষ নির্মাণ করে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আত্মার প্রেরণায়। ব্যবসায়ের প্রয়োজন যখন অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠতে থাকে তখন আত্মার বাণী নিরস্ত হয়ে যায়। ধনী তখন দিব্যধামের পথের চিহ্ন লোপ করে দেয়, সকল পথকেই হাটের দিকে নিয়ে আসে।”

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। ইদানীং কালে সময় কাটানোর জন্যে আমি মাঝে মাঝে গল্প লিখি। এদিক ওদিকে দু-চারখানা প্রকাশিতও হয়ে যায়। একবার সেইরকম খান তিনেক গল্প প্রিন্ট করে এনে ওনাকে পড়তে দিলাম। দেওয়া মাত্র উনি চশমা টেনে গল্পগুলো পড়তে বসে গেলেন। আমি উৎসাহ নিয়ে তো ওনাকে পড়তে দিলাম। কিন্তু দেওয়ার পরে আমি মনে মনে ভাবছি, এই বয়সে এইরকম অর্বাচীনের মত কাজটা না-করলেই হয়ত ভালো করতাম। পড়ে হয়ত উনি ভাববেন, কি এক আহাম্মকের সাথে আমার মেয়েটাকে জীবনটা কাটাতে হচ্ছে। উপরের দিকে একবার পাথর ছুড়ে দিলে নিজের মাথা বাঁচানো ছাড়া যেমন আর কোন উপায় থাকে না, সেইরকম আমিও তারপর থেকে ওনার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আর উনি আমার পিছনে পরে আছেন যে কখন বসব সেই গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করতে। ওনার স্বাস্থ্য তখন বেশ খারাপের দিকে। মাঝে মাঝে ভুলে যান, কখনো পরিচিতদেরও চিনতে পারেন না। অথচ যখন ওনার সাথে বসলাম, দেখলাম গল্পগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে আছে এবং আলোচনার সময়ে সেখান থেকে quote করে বলে গেলেন। যাহোক, আমাকে উৎসাহ দিয়ে অনেক কথা বললেন। গল্পে চরিত্র কিভাবে গড়ে তুলতে হয় সেসব বললেন। অনেক তারিফ করলেন। ‘অনুষঙ্গ’ নামে আমার একটা গল্পকে যখন উনি ভালো বললেন, আমি বললাম, এটা ছেলেমানুষি করে লেখা। এটাকেও আপনি ভালো বলছেন?

তারপরে একটা দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পরে কথা বললেন, এর মধ্যে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে, তবে এটা তোমার একটা নিকৃষ্ট মানের লেখা হয়েছে।

কোন গর্হিত কাজ করে অভিভাবকদের কাছে বকা না-খাওয়া পর্যন্ত যেমন নিজের মধ্যে একটা স্বস্তি পাওয়া যায় না, আমার অবস্থাটাও অনেকটা সেইরকম হয়েছিল। ওনার কথা শুনে আমি তখন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তারপরে বললাম, আপনার judgement-এর সাথে আমি একমত। এটা কোন ভালো মানের লেখা নয়, কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় লেখাগুলোর মধ্যে এই গল্পটা একটা। শুনে উনি বললেন, লেখকদের অনেক সময়ে বাজারের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে লিখতে হয়। কিন্তু তোমার তো সেরকম কোন অভিপ্রায় নেই। আমি ওনার কথায় সায় দিলাম। উনি বললেন, তাহলে যেটা ভালো বলে মনে কর সেইরকম জিনিষ লেখ। আমি যা বোঝার তা বুঝলাম।

রবীন্দ্রনাথ আত্মপরিচয়ে বলেছিলেন, “যাহা আমার তাহাই আমি অন্যকে দিয়াছিলাম–ইহার চেয়ে সহজ সুবিধার পথ আমি অবলম্বন করি নাই। অনেক সময়ে লোককে বঞ্চনা করিয়াই খুশি করা যায়–কিন্তু সেই খুশিও কিছুকাল পরে ফিরিয়া বঞ্চনা করে–সেই সুলভ খুশির দিকে লোভদৃষ্টিপাত করি নাই।” শ্রী অমিত গুপ্ত এই একই কথায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজের জীবন দিয়ে সেটা মেনে এসেছেন। অন্যকেও সেই পথে যেতে উৎসাহিত করেছেন। “যে-লেখকের অন্তরেই বিশ্বশ্রোতার আসন তিনিই বাইরের শ্রোতার কাছ থেকে নগদ বিদায়ের লোভ সামলাতে পারেন। ভিতরের মহানীরব যদি তাঁতে বরণমালা দেয় তা হলে তাঁর আর ভাবনা থাকে না, তা হলে বাইরের নিত্যমুখরকে তিনি দূর থেকে নমস্কার ক’রে নিরাপদে চলে যেতে পারেন।”

অমিত গুপ্তের সঙ্গটাই একটা শিক্ষালাভ। যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা আমার এই কথাটি গভীরভাবে অনুভব করতে পারবেন। খালকাটা জলে পানা জমে। যে নদী হুহু করে বয়ে যায়, সেখানে পানা এলেও, তা সেই জলকে পচাতে পারে না। আবর্জনাও সেখানে দিয়ে যেতে যেতে একসময়ে পরিস্রুত হয়ে যায়। অমিত গুপ্তের সংস্রবটা অনেকটা সেইরকমই। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি এতই বড় ছিল যে তার কাছাকাছি এলে সেই স্রোতে না-ভেসে আর কোন উপায় থাকত না। তাঁর সাথে আলোচনা করতে বসলে এক প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে সে আলোচনা থামবে তার কোন সীমা থাকত না। সুন্দর জিনিষ দেখলে মনের মধ্যে একটা পবিত্র দিক খুলে যায়, তখন অসুন্দরের প্রতিও তেমন বিরূপ মনোভাবের উদয় হয় না। কারণ সৌন্দর্যের মহিমা তখন এতটাই প্রভাব ফেলে যে আশেপাশে অসুন্দর তখন গ্রাহ্যের মধ্যে আসে না। তেমনই এইরকম ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এলে মানুষের মানবিক দিকের এমন বিকাশ ঘটে যে তখন তুচ্ছ, নিকৃষ্ট চিন্তা মনে স্থান পায় না। এই রকম কোন ব্যক্তিত্বকে উদ্দেশ্য করে কোন এক আদিম কবি লিখেছিলেন, “তমেব মাতা চ পিতা তমেব, তমেব বন্ধুসচ সখা তমেব, তমেব বিদ্যা দ্রবিনং তমেব, তমেব সর্বং মম দেবদেব।।”

অমিত গুপ্তের জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা কোন খালকাটা জলের মত ছিল না। তিনি নদীর মত আপনার গতিতে নিজের ধারায় বয়ে যেতেন। তিনি কারো স্বাক্ষরিত অভিজ্ঞানপত্রের জন্যে অপেক্ষা করেন নি। নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং রসবোধ দিয়ে তিনি যা অর্জন করেছিলেন, যুগের দাবীকে মর্যাদা দিয়ে তাই লিখেছিলেন, “সঞ্জয় উবাচ”।

ছোটগল্প কি? তা রবীন্দ্রনাথের মত পরিষ্কার করে পৃথিবীতে কোন ভাষায় আর কেউ বলতে পারেন নি। অনুগল্প কি? – এই কথা অমিত গুপ্ত যেমন করে বলেছেন তেমন আর কোথাও পাই না। তাঁর কথায়, “আকার নিয়ে প্রচলিত মত এই যে পোস্টকার্ডে লেখা যায় এমন গল্পই অনুগল্প। ধারণাটা ঠিক নয়। একটা ছোটগল্প ভাঙ্গলে যে উপাদানগুলি পাওয়া যায় তাই দিয়ে অনুগল্পের নির্মিতি। অনুগল্প শেষ হয় ‘তারপর?’ এই চিরন্তন জিজ্ঞাসায়। অতৃপ্তিই এর প্রাপ্তি।”

“সাহিত্যের একটা গুণ হচ্ছে অপূর্বতা, ওরিজিন্যালিটি। সাহিত্য যখন অক্লান্ত শক্তিমান থাকে তখন সে চিরন্তনকেই নূতন ক’রে প্রকাশ করতে পারে। এই তার কাজ। এ’কেই বলে ওরিজিন্যালিটি। যখনি সে আজগবিকে নিয়ে গলা ভেঙে, মুখ লাল ক’রে কপালের শিরগুলোকে ফুলিয়ে তুলে ওরিজিন্যাল হতে চেষ্টা করে, তখনি বোঝা যায় শেষ দশায় এসেছে।” বনফুলের পরে বাংলা সাহিত্যে এইরকম কাজ খুব একটা দেখা যায় না। সময় একদিন সমাজের কাছ থেকে এর যথার্থ মূল্য কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেবে। ইতিহাস আমাদের সেটাই দেখিয়েছে।

মালদা শহর তার একটা অন্যতম অলঙ্কার হারালো। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেলেই তাঁর প্রতি সত্যিকারের সম্মান দেখান হবে, তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করা হবে।

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥”

কল্লোল নন্দী

আটলান্টা

আগষ্ট ১৫, ২০১৫