Home » ছোট গল্প » আমেরিকান লাইফ » পুলিসের নস্য পরীক্ষা

পুলিসের নস্য পরীক্ষা

সারা শহরে হৈহৈ-রৈরৈ সেদিন – ইন্দিরা গান্ধী আসছেন। শহরের মাঝখানে বৃন্দাবনী মাঠে বড় মাচা করে স্টেজ বানানো হয়েছে। চারিদিক থেকে আগের দিন দুপুর থেকে লোক এসেই যাচ্ছে। বেলা একটা নাগাদ দেখা গেল একটা হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ির উপর বেশ কয়েকবার চক্কর কেটে অন্যদিকে চলে গেল। সবাই বলল, ওতে করে ইন্দিরা গান্ধী এলেন। হেলিকপ্টারটা দেখতে অনেকটা ফড়িঙের মত। ফড়িঙ যখন জলের উপরে ওড়ে তখন ফড়িঙের ডানা থেকে যেমন একটা শব্দ হয় হেলিকপ্টারের শব্দটাও অনেকটা ওইরকম – তবে আওয়াজটা অনেক বেশী।

এই ঘটনার কয়েকদিন আগে স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাসে মেটাল চ্যাপ্টার পড়িয়েছে। তাতে বলা ছিল অ্যালুমিনাম দিয়ে উড়োজাহাজ তৈরি হয়, কারণ অ্যালুমিনাম ধাতু শক্ত এবং হালকা। উড়োজাহাজ অ্যালুমিনাম দিয়ে তৈরি হোক বা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি হোক – পাসের জন্য মুখস্থ মেরে দিয়েছি আর লাইনটার তলায় দাগ দিয়ে রেখেছি। পরীক্ষার আগে ওইগুলো দেখে যাব, ব্যাস ওই পর্যন্ত। কিন্তু, অ্যালুমিনাম ধাতু শক্ত এবং হালকা – এইটে মানতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। বাড়িতে এসে ভাতের হাঁড়ি পরখ করে দেখলাম, লোহার মত ভারি না হলেও উড়ে যাওয়ার মত হালকা নয়। আর শক্ত কথাটা অত্যন্ত বাজে কথা, বলা যেতে পারে পুরটাই ভুল। দেখলাম, রান্নাঘরে এমন একটা অ্যালুমিনাম বাসন নেই যেটা একটুও টপসে যায় নি।

সে যাহোক, মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা উড়ে যাওয়ার পর থেকে মনের মধ্যে উসখুস করতে লাগল যে হেলিকপ্টার সত্যি কি অ্যালুমিনাম দিয়ে তৈরি নাকি ওর মধ্যে গ্যাস বেলুনের গ্যাস ভরা থাকে। ছোটদের বুক অব নলেজে টেনে বের করলাম কিন্তু এর কোন সদুত্তর পেলাম না। ঘণ্টা খানেক পরে সুযোগ এল হেলিকপ্টার দেখতে যাওয়ার। পাড়ার এক দাদা বলল, ও এরোড্রামে যাবে। বাড়িতে কেউ ছিল না তখন। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করে সেই পাড়ার দাদার সাইকেলে চেপে এরোড্রামে গেলাম। দূরে সাইকেল রেখে সেই দাদা এর-তার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল আর আমি তার পেছন পেছন চললাম। এক সময় সেই দাদা অন্যদের মত দুই লাইনের একটাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা শেষ করে এই দুই লাইন করে দাঁড়ানো লোকজনদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে হেলিকপ্টারে উঠবেন। আমি ওর পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, আস্তে করে কেটে পড়লাম। ধীরে ধীরে হেলিকপ্টারের লেজের কাছে গিয়ে লেজের ডানাটা যেই একটু ছুঁয়েছি অমনি কোত্থেকে একটা পুলিস এসে বন্ধুকটা নাকের কাছে ধরে আমকে হাত ধরে টানতে টানতে অনেক দূরে সরিয়ে দিল। ভালো করে পরখ করে দেখার পরে যদি আমাকে সরিয়ে দিত তাহলে আমার কোন দুঃখ হত না। দূরে বসে অনেকক্ষণ ধরে হেলিকপ্টারটা দেখলাম – কিন্তু কিছুতেই মানতে পারলাম না যে ওটা অ্যালুমিনাম দিয়ে তৈরি। বাড়িতে না-বলে এরোড্রামে আসা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাওড়া ব্রিজের উপর থেকে ঝাপ দেওয়া সেই সময়ে একই ব্যাপার। একসময়ে বুঝলাম যে ইন্দিরা গান্ধী খুব শীঘ্রই আসছেন না। তাই পাড়ার দাদাকে বলে হেঁটেই বাড়ি ফেরত এলাম। অন্তত বকা বা পিটুনির পরিমাণ যতটা কমানো যায়। আর সেই থেকে পুলিসের উপর কৌতূহল এবং আমার যত রাজ্যের রাগ। পুলিসকে নাস্তানাবুদ হতে দেখলে আমার ভীষণ মজা লাগে। সেই নিয়েই এই গল্প।

পুলিসের পেশায় কি হয় তা জানি না। তবে এটুকু দেখেছে যে, পুলিশ কখনো হাসে না। আমার বন্ধু নিরুপম এমনিতে ভীষণ রসিক মানুষ। তার বাড়িতে বসে ঠাট্টা-ইয়ার্কি হচ্ছে। নিরুপম বলল, আমাকে এবার যেতে হবে। বুঝলাম, ওর ডিউটি আছে তাই আড্ডার মাঝখান থেকে উঠে যেতে হচ্ছে। কয়েক মিনিট পরে নিরুপম বহু রকমের তকমা লাগানো পুলিসের পোশাক পরে এল, আমাদের আড্ডা তখনো চলছে – নিরুপম শুনছে কিন্তু হাসছে না। দেখে ভারি মজা হল। ইচ্ছে করে বেশ কয়েকটা তামাসা করা হল, কিন্তু আর কোন হাসি নেই নিরুপমের। অথচ এতক্ষণ এই নিরুপমই ছিল আমাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। সৈনিকের পোশাকে হাসতে দেখেছি, বাচ্চাদের চকোলেট দিচ্ছে, ফুল দিচ্ছে – ছবিতে দেখেছি। আজ অবধি পুলিশকে ওইরকম অবস্থায় দেখিনি। কেন এমন হয় – তা জানি না। মনে হয়, কারুর হাসি যদি থামাতে হয়, দাও পরিয়ে পুলিসের পোশাক!

সে যাহোক, আসল কোথায় আসি। স্বদেশ বাবু জীবিকার কারণে বিদেশে যান – একটানা কয়েকমাস তাঁকে বিদেশে থাকতে হয়। স্বদেশ বাবুর একটি নেশা – নাকে নস্য নেওয়া। বিদেশে নস্য পাওয়া যাবে কি না তার পরোয়া না-করে উনি সাথে করে নস্য নিয়ে যান। একবার ইমিগ্রেসনে ওনার সমস্ত সুটকেস খুলে চেক করার সময় ওনার নস্যর কৌটা বের হয়ে আসে। স্বদেশ বাবুকে জিজ্ঞেস করে, এটাতে কি আছে? স্বদেশ বাবু বলেন, নস্য, snuff.

বাংলায় নস্য, আর ইংরাজিতে snuff – অর্থের দিক দিয়ে ঠিক হলেও, ইংরাজদের পক্ষে এই নস্য বা snuff – এর তাৎপর্য বোঝা, এবং তার সমাদর করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তারা এটাকে কোন অত্যাধুনিক মাদকদ্রব্য ভেবে সেটা পরীক্ষা করার জন্যে একটা যন্ত্র এনে তার একটা কাঠি নস্যর কৌটোয় ঢুকিয়ে দিলেন। স্বদেশ বাবু পরিত্রাহি চিৎকার করে বললেন, আহা! করেন কি? করেন কি মশায়? এ আমার কাছে অতি মহামূল্য দ্রব্য। আপনারা যা পরীক্ষা করার করুন, দয়া করে নিচে ফেলবেন না। একটা কাগজের উপরে রেখে করুন। কৌটো থেকে পরে গেলেও আমি অন্তত সেখান থেকে তুলে নিতে পারব।

যন্ত্রের একটা কাঠি ততক্ষণে নস্যর কৌটার মধ্যে, বোতাম চেপা হল, কিন্তু যন্ত্রের কাঁটা একটুও নড়ল না। ইংরাজ ইমিগ্রেসন পুলিস মহা ধন্ধে পড়ল। কি করা যায়? চোখের উপর দিয়ে এইরকম অত্যাধুনিক মাদকদ্রব্য পাচার! হাতে নাতে ধরেও কিছু করা যাচ্ছে না। ডাকা হল বড় বাবুকে। আনা হল দুই খানা কুকুর।

বেচারা কুকুর দুটো যেই না একবার নস্য শুঁকেছে – অমনি পরিত্রাহি হাঁচি। আর সেই হাঁচির তোড়ে বেশ কিছুটা নস্য বাতাসে উড়তে লাগল। স্বদেশ বাবু তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন আর বলছেন, মশায়, আপনারা আমার কথা শুনলেন না। আমার এই মহামূল্য নস্যর এতটা নষ্ট করে দিলেন। কতবার বললাম, একটা কাগজের উপর নিয়ে আপনাদের তামাসাগুলো করুন।

এদিকে প্রথমে পুলিস তারপরে পুলিসের বড় বাবু হাঁচির পরে হাঁচি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইমিগ্রেসন এলাকায় যত লোক ছিল একে অপরের ঘাড়ে-মুখে হাঁচি আর হাঁচি। কারুর নাক দিয়ে পোঁটা বের হচ্ছে, তো কারুর চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছে – মোছার সময় কোথায়? প্রথমটা সামলাতে না সামলাতে দ্বিতীয় হাঁচি। যদিও বা সেটা সামলানো গেল পাশের লোকের হাঁচির চোটে কফ-থুতু মুখের উপর এসে পরে। তখন কে দেবে নির্দেশ, আর কে তা করবে পালন?

এরই মধ্যে একজন ইমিগ্রেসন পুলিস নাকে মুখে টিসু-কাগজ চাপা দিয়ে স্বদেশ বাবুকে কোন রকমে বলল, Pack your stuff and get out immediately. স্বদেশ বাবু মনের দুঃখে যেটুকু নস্য ছিল, তাই নিয়ে সুটকেস বন্ধ করে সেখান থেকে বিদায় নিলেন। কি আর করা? স্বদেশ বাবুকে বাকি নস্যটুকু নিয়ে সেইবার বিদেশ যাত্রা করতে হল।

— শেষ —