Home » ছোট গল্প » প্রেম-পর্ব » অ্যালবাম

অ্যালবাম

হাত ফসকে কোন কাঁসার বাসন মেঝেতে পড়লে প্রথমে ঠান করে একটা শব্দ হয়, তারপর ঝনঝন করে কিছুক্ষণ ধরে বাজে। সেটা থেমে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ ধরে সেই শব্দ কানের মধ্যে লেগে থাকে। বিকাশজ্যোতির সাথে দীপার গতকালের দেখা হওয়াটা দীপার কাছে অনেকটা সেইরকম – অকস্মাৎ দেখা হওয়া, তারপর ঝনঝন করে খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনা। এখন আর তার কিছুই নেই – কিন্তু দীপার কানের মধ্যে বিকাশজ্যোতির কথাগুলো বেজেই যাচ্ছে।

গতকাল বিকাশজ্যোতির সাথে দেখা হাওয়ার ঘটনাটা মনে পরতেই দীপার বিকাশজ্যোতির উপর ভয়ঙ্কর রাগ হল। মনে হল, সিনেমার শেষে ওকে ডাকার কি দরকার ছিল? দেখে চুপচাপ চলে গেলেই পারত – পুরো সিনেমাটাতে ওর পাশে একজন অচেনা লোকের মত বসে চুপচাপ করে কাঁটালো আর শেষ মুহূর্তে ওকে না ডাকলেই কি ওর চলছিল না? পর মুহূর্তে মনে হল, বুঝলই যদি যে সে পাশে বসে আছে তো আগে কথা বলল না কেন? সারাক্ষণ হাতলের উপর হাত রাখার জন্যে একজন অচেনা লোকের সাথে ঠেলাঠেলি করতে হত না।

নির্জন দুপুরে স্মৃতিগুলো যখন এসে থাকে থাকে নিজের জায়গা দখল করে বসা শুরু করেছে, সেই সময়ে দীপার ব্যাগের ভিতরে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। দীপা অনিচ্ছা স্বত্বেও ওর শ্লথ শরীরটা টেনে খাট থেকে নেমে টেবিলের উপরে রাখা ব্যাগটা খুলল মোবাইলটা বের করার জন্যে। ফোনের ঠিক পাশেই রাখা ছিল বিকাশজ্যোতির দেওয়া বিজনেস কার্ড। কার্ডটা সরিয়ে ফোনটা তুলতেই ফোনটা কেটে গেল – কেউ একটা মিসড কল দিল। মানুষটা যখন নিজেই তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন তার বিজনেস কার্ডে দীপার কোন আগ্রহ ছিল না। এখন সে নেই, তার বিজনেস কার্ডটাই তার উপস্থিতি – মিসড কলের মত – কোন কথা নেই, কিন্তু উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়।

এই ফোনেরও অদ্ভুত কাণ্ড – যখন দরকার তখন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আর যখন চাই না ঠিক তখনই এসে গোলমাল পাকায়। গতকাল সিনেমা শেষ হাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই ড্রাইভারের SMS চলে এলো – Madam, car ready. গাড়ি বেশিক্ষণ সেখানে দাড়াতে পারবে না। তাই ওকে তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছিল। ভালো করে কথাও বলা হল না। আসলে, কিছুই জিজ্ঞেস করা হল না। এতগুলো প্রশ্ন একসাথে কি করেই বা বলতে পারত। ফোনটা তখন আউট-অফ-নেটওয়ার্ক হলে আরো বেশ কিছুক্ষণ থাকা যেত। দীপার নিজের উপরেও রাগ হল। সারাদিন কত মার্কেটিঙের SMS আসে – সেরকম মনে করে ওই সময়ে ফোন না দেখলেও তো পারত। কি আর এমন ক্ষতি হত? ড্রাইভার বড়জোর কিছুটা ঘুরে আরেকটু পরে আবার আসত।

ছবির অ্যালবামে একটা ছবির সাথে অন্য ছবি যাতে না সেঁটে যায় তাই দুইখানা ছবির মধ্যে একটি করে অয়েল পেপার দেওয়া থাকে। পুরানো অ্যালবামে কখনো সখনো সেই অয়েল পেপার ছবির সাথে সেঁটে গেলে ছবিটা আর ভালো করে দেখা যায় না। অয়েল পেপারটা টেনে ছবি থেকে আলাদা করার চেষ্টা করলে প্রায়শ ছবিটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন আফসোস হয় – সেই তো ভাল ছিল, আবছা হলেও তা অক্ষত ছিল, এখন যে তা ছিঁড়ে গেল।

দীপা বড়লোক বাড়ীর সুন্দরী রূপসী মেয়ে, ছোট থেকে নিজের জগতে বড় হয়েছে। খেলাধুলোর সঙ্গী সাথী সবাই তার বাড়ীর মধ্যে থাকা মানুষগুলো। স্কুলে যেত গাড়ি করে আর স্কুল ছুটির পরে স্কুলের বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। সেই গাড়ি করে বাড়ি ফেরত আসত। স্কুলের বন্ধুদের সাথে গল্পগুজব ক্লাসের ফাঁকে যেটুকু হয় সেটুকুই, তার বেশী নয়। অতএব বন্ধু বলতে তার বিশেষ কেউ ছিল না।

এইভাবে দীপার দিন ভালোই কাটছিল যতদিন না ওর সহপাঠিনীরা একে একে প্রেম করতে শুরু করল। প্রেমের রোমাঞ্চকর গল্পের আসরে কেউ তাকে নেয় না, বরং দীপা এলে তারা প্রসঙ্গ পালটে দেয়। দীপা মনে মনে ঠিক করল, প্রেম যদি নাও করে, অন্তত দুই-একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে।

দীপা যে খুব সুন্দরী সেটা সে ভালো করে জানত। চিরিয়াখানায় বাঁদরের খাঁচায় একখানা কলা একটুখানি ঢুকিয়ে দিলে ঝুপঝাপ করে বাঁদরগুলো যেমন নিতে আসে, দীপা ভাবল, গল্পের নায়িকার মত ও একটু হেসে কথা বললেই সব ছেলেপুলে ঝেঁপে পড়বে। সেটা হতে পারত, কিন্তু খাঁচায় বন্দি দীপার কাছে মুক্ত ঘুরে বেড়ানো বাঁদরেরা আসবে কেন?

অঙ্ক কষে বিয়ে হয়, বন্ধুত্ব বা প্রেম হয় না। শুধু হাসিতে যখন কাজ হল না, তখন বন্ধুত্ব বাড়ানোর জন্যে পড়াশুনোর নোটের আদান প্রদান বাড়তে লাগল যাতে সেই অছিলায় কারো সাথে যদি বেশী বন্ধুত্ব করা যায়। কয়েকজনের সাথে কথাবার্তার পরিমাণ বাড়ল বটে, কিন্তু সেসব নেহাতই কাজের কথা। নিজের মনের কথা তো দূরে থাক, অন্যের গল্পও কেউ তার সাথে করে না। দীপাকে কেউ ওসবের যোগ্য বলেই মনে করে না।

এদিকে দীপা আরব্য রজনীর মত প্রতি রাতে কারুর সাথে প্রেম করে আর পরের দিন সকালে সেই প্রেমের বলি দেয়। কিছুদিনের মধ্যে দীপার জানা সম্ভাব্য সমস্ত পুরুষের সাথে অন্তত একবার করে ওর প্রেম করা হয়ে গেল, কিন্তু কোন কাজের কাজ হল না।

কোন এক রাতে অনেকের সাথে একটা বাসে করে দীপা কোথাও যাচ্ছিল। বাসটা যখন ভীষণ রকমের উঁচু ব্রিজের উপরে উঠে মাঝখান অবধি এসেছে ওমনি ব্রিজটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। সবাই চারিদিকে ছিটকে পড়ল। দীপাও পড়ে গেল – মনে হল সে এক অনন্তকাল ধরে পড়ে যাওয়া। এমন সময় কোত্থেকে একটি কালো জামা কালো প্যান্ট পরা ছেলে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দীপা তোমার কোন ভয় নেই।” দীপা তখনও পড়ে যাচ্ছে আর ভয়ে চিৎকার করছে। এমন সময়ে কারুর ঠেলাতে ওর চোখ খুলে গেল, দ্যাখে ওর মায়ের হাত ওর কপালে।

– কিরে ওরকম করে চিৎকার করছিস কেন? তোর তো দেখছি গা পুড়ে যাচ্ছে।

ওষুধ আর জল খেয়ে দীপা সেই রাতের মত ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন থেকে তার স্বপ্নের প্রেম বন্ধ হয়ে গেল। খোঁজা শুরু হল সেই জামা কালো প্যান্ট পরা ছেলেটাকে। মাঝে মাঝে মায়ের উপর ভীষণ রাগ হত – কেন যে আর একটু পরে এলো না। ছেলেটার মুখটাই ঠিক করে দেখতে পেল না। দীপাকে বেশিদিন খুঁজতে হয় নি। সপ্তাহ দুয়েক পরে তাদের এক আত্মীয়ের পারিবারিক অনুষ্ঠানে আলাপ হল একটা কালো জামা কালো প্যান্ট পরা ছেলে – বিকাশজ্যোতির সাথে। দীপা পরিষ্কার বুঝতে পারল মুখটা পরিষ্কার করে দেখতে না পারলেও সেদিন বিকাশজ্যোতি এসেছিল ওকে বাঁচাতে। এরপরে বিকাশজ্যোতির সাথে দীপার ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বাড়তে থাকল। একদিন দীপা বিকাশজ্যোতিকে সোজাসুজি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসল।

বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে সোজাসুজি প্রেম নিবেদন পেয়ে, বিকাশজ্যোতি এককথায় রাজি। এমনিতে দীপার ঘনিষ্ঠতার মাত্রা দেখে বিকাশজ্যোতির যে সে কথা মনে আসে নি তা নয়, তবে সেটা যে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে তাও সে ভাবে নি। রাতারাতি ওদের প্রেম শুরু হয়ে গেল। কিছুদিন যাওয়ার পরে, একদিন দীপা বন্ধুদের প্রেমের গল্পের আসরে ফাঁস করল যে ও বিকাশজ্যোতির সাথে প্রেম করছে। এক মুহূর্তে সবার সব গল্প বন্ধ – দীপা তখন তাদের সকলের কেন্দ্রবিন্দু। দীপা বলে চলল, বুঝলি তো, আমি এই বললাম, সেই শুনে বিকাশজ্যোতি সেই বলল। তার পরে বিকাশজ্যোতি এই বলল, আর আমি এই বললাম। বন্ধুদের কেবল একটাই প্রশ্ন – “তারপর?” এরপর থেকে বান্ধবীদের প্রেমের গল্পের আসরে দীপার একটা পাকাপাকি জায়গা হয়ে গেল। ও থাকলে কেউ আর আগের মত প্রসঙ্গ পালটায় না।

দীপার চোখ পড়ল বারান্দায় মেলে রাখা গতকাল পড়া শাড়িটার দিকে। বিকাশজ্যোতির সাথে আইসক্রিম খাওয়ার সময় ছেলের চকোলেট আইসক্রিম শাড়িতে লেগে গিয়েছিল, সেই দাগটা সম্পূর্ণ উঠে গেছে। দোকানে দিয়ে পরিষ্কার করালেও কত শাড়ি থেকে কত দাগ ওঠে না। আর এটা একবার জল দিয়ে ধুতেই উঠে গেল।

দীপা বারান্দায় এল শাড়িটা তুলে রাখার জন্যে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে লোক দেখতে দেখতে মনে পড়ল – বন্ধুর বাড়ির নাম করে বিকাশজ্যোতির সাথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান, আর সেই বন্ধুই তখন ওর বাড়িতে এসে হাজির; সিনেমা হলে কোনার দিকের সিটে বসে সিনেমা দেখছে, হঠাৎ দেখে সামনেই বসে আছে এক চেনা লোক; বিকাশজ্যোতির সাথে হেঁটেছে কত অচেনা গলি-রাস্তায় যেগুলো বাঁক নিয়েই ঝুপ করে উঠে আসে বড় রাস্তার মোড়ে; আত্মীয়দের সাথে পিকনিক করতে গিয়ে ওর সাথে অনেকক্ষণ হারিয়ে যাওয়া; এক ছাতার নিচে বৃষ্টিতে না-ভেজা; জোর করে ওকে নাগর-দোলায় চড়ানো; বিকাশজ্যোতি কু-কর্মকার; ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া; অন্ধকারে জড়িয়ে ধরা; প্রথম চুম্বন; রাগ-অনুরাগ; চপ, কাটলেট, ফুচকা খাওয়া; খেলার মাঠ; পূজা মণ্ডপ; মান-অভিমান; কান্না-হাঁসি; দরজায় বেল – টিং টং।

বারান্দা থেকে শাড়িটা তুলে বিছানার উপর রেখে দীপা দরজা খুলল। বাড়ির কাজের মেয়েটা এসেছে।

– বৌদি, কি হয়েছে? ওরকম করে হাঁপাচ্ছেন কেন?

– কিছু না। হঠাৎ উঠে দরজা খুললাম, তাই।

কাজের মেয়েটা শোয়ার ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে মুচকি হেঁসে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। আর দীপা ঢুকল বাথরুমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝল যে ও ভীষণ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, এতক্ষণ ধরে হাঁপাচ্ছিল – কাজের মেয়েটার কাছে ধরা পরে গিয়ে লজ্জার এক শেষ। আয়নায় দেখল তখনও তার বুকটা ওঠা নামা করছে। ভালো করে ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হয়ে, মুখ মুছে, চুল আঁচড়ে, বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।

শাড়িটা আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে দীপা বুঝতে পারল, পুরানো প্রেমের ছবিগুলো আজ আর তেমন স্পষ্ট নয়। সংসার আর পারিবারিক দায়িত্ব অয়েল পেপার হয়ে অনেক ছবির সাথে সেঁটে গেছে – তাদের যে কোন একটাকে একটু টানলেই ছবিগুলোই যেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

— শেষ —