বিল্টু মোটামুটি ওর স্নান, খাওয়া, ঘুম এবং কলেজের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা আমাদের হোস্টেলেই কাটাত। বিল্টু থাকত আমাদের হোস্টেল সংলগ্ন প্রফেসর কোয়ার্টারে। ওর বাবা ওই কলেজেই পড়াতেন – বড় সজ্জন মানুষ। আমাদের নানারকম পরোক্ষ অত্যাচার সত্যেও কোনদিন উনি কোন অভিযোগ করেন নি। বিল্টুর বাড়ীর পেছনে কাঁঠাল গাছে অনেকগুলো কাঁঠাল পেকে রয়েছে – আর সেই পাকা কাঁঠালের গন্ধে সারা হোস্টেল ম ম করছে। ওই বয়েসে আর যাই হোক কাঁঠালের প্রতি কোন আসক্তি হওয়ার কথা নয়, এবং হয়ও নি। কিন্তু কে যে কেন হঠাৎ আম-কাঁঠালের কথা তুলল, আর সে কথা নানা পথ ঘুরে ঘুরে শেষে কাঁঠালেই এসে আটকে গেল – তা আজ আর মনে নেই। নানান কথা বার্তা বেজায় বিতর্ক শুরু হল কাঁঠাল নিয়ে। কাঁঠাল কাকে বলে? উহা কয় প্রকার ও কি কি? তাদের চেনার কি উপায় ইত্যাদি ইত্যাদি। খাজা কাঁঠাল, পাকা কাঁঠাল, আরো কত কি। কাঁঠালের এক এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি হয়ে গেল। এত কথা হাওয়ার পরে কাঁঠাল খাওয়া না হলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায় – তাই এই উদ্যোগ।
বিল্টু বা বিল্টুর বাবা, উৎপল বাবুর কাছে চাইলে হাঁসি মুখে দিয়ে দিতেন, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না, কিন্তু এতে প্রথমত চেয়ে খাওয়ার গ্লানি থেকে যায় এবং দ্বিতীয়ত তাতে কোন উৎসাহ বা অ্যাডভেঞ্চার থাকে না। শুরু হল পরিকল্পনা।
প্রথমে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার যোগাড় করে দেখা গেল তিনদিন পরেই অমাবস্যা। ঠিক হল সেই রাতে কাঁঠাল পারা হবে। তিনজন পটাপট দায়িত্ব নিলো এই কাজের, একজন গাছে চড়ে কাঁঠালটা কাটবে, বাকি দুজন সেটাকে লুফে নেবে যাতে কাঁঠাল মাটিতে পড়ার কোন শব্দ না হয়। একমাত্র বিপত্তি ওই বিল্টু – কারণ সেই গাছের পাশেই ওর শোয়ার ঘর। মাঝরাতে শব্দ শুনে বেড়িয়ে এলে ও কি করে বসতে পারে তা নিয়ে কোন সর্বসম্মত ধারনা করতে পারা গেল না, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যে – সে হয়ত ভয়ে ফিট লেগে যাবে। এটা কোনমতেই হতে দেওয়া যায় না কারণ সে অবস্থায় তো ওকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া যায় না, আবার কাঁঠাল চোর বন্ধুরা ফিট লাগা ছেলেকে সুস্থ করে তুলছে – সেটাও কারুর কাম্য নয়। সুতরাং বিল্টুকে ওখান থেকে সরাতে হবে। বিল্টুকে বলা হল সেই রাতে খাওয়া-দাওয়া করে হোস্টেলে চলে আসতে। সবাই মিলে ফিজিক্স প্রাক্টিকালের ফাইনাল খাতা তৈরি করা হবে। আজন্মকাল থেকে একই গ্রাফ, একই পদ্ধতি চলে আসছে – এসবের আসল লেখক কে তা কেউ জানে না। যাহোক, বেশ কিছু কথাবার্তার পরে বিল্টু এই প্রস্তাবে রাজি হল – না হয়ে ওর উপায়ও ছিল না।
যথারীতি নির্ধারিত রাতে যথাসময়ে বিল্টু এলো খাতাপত্র, গ্রাফ-পেপার, সরু পেন্সিল ইত্যাদি নিয়ে। সবাই বসল প্রথমে লাইট-ট্রেস করে গ্রাফগুলো সারতে, তারপর হবে অন্যান্য সব – একে একে। ওদিকে নির্ধারিত তিনজন চলে গেল কালো জামা, কালো হাফপ্যান্ট পরে কাঁঠাল পারতে। যেটার ভয়ে এতকিছু করা, সেইটেই ঘটল। কিছুক্ষণ পরে একটা ধপ করে শব্দ এবং “আ” বলে একটা চাপা চিৎকার। দুটোই চাপা হলেও বেশ পরিষ্কার শোনা গেছে।
বিল্টু তড়াক করে উঠে বলল, নিশ্চয় কেউ কাঁঠাল চুরি করছে।
সে ঘরের সবাই বেশ থতমত – যে কেউ ওকে বলে দেয় নি তো? হোস্টেলে বিরোধী পক্ষের কোন অভাব নেই!
যারা বিল্টুর সাথে একসাথে কপি করছিল তাদের মধ্যে একজন বলল, চোরের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, এত রাতে আসবে কাঁঠাল চুরি করতে? তাও আবার হোস্টেলের পাশেই?
না, বুঝলি তো, কয়েক বছর আগে… – বিল্টু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।
আর এগোতে দেওয়া যায় না ওকে। এসব ছেলেপুলে কখন যে অকারণে সাহসী হয়ে ওঠে তার কোন ভরসা নেই।
একজন বলল, চুরি করলেও কাঁঠালই চুরি করেছে, তোকে তো আর চুরি করে নিয়ে যায় নি। নে, যে কাজ করতে এসেছিস, সেইটেই কর।
বিল্টু হয়ত ভাবল, সেও সত্যি কথা, বা ওর সাহসিকতাকে নিয়ে ঠাট্টা ওর পছন্দ হল না। যে কারণেই হোক না কেন, বিল্টু আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে বলতে আবার কপি করাতে মন দিল। এইভাবে আরও কিছুক্ষণ গেল। তারপরে একজন ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল, কি রে তোরা আজ তাস খেলবি না? বোঝা গেল – কাজ সম্পন্ন হয়েছে নির্বিবাদে। না হলে, সে চায়ের জন্যে চিনি চাইতে আসত।
এবার বিল্টুকে বাড়ি পাঠানোর সময়। নানা ছুতোনাতা করার পরেও যখন কাজ হল না, তখন সবারই একসাথে ঘুম পেতে শুরু করল। অবশেষে সেই রাতের মত কপি করা মুলতুবি থাকল এবং বিল্টু বাড়ি চলে গেল।
সব হোস্টেলেই অন্তত একটা চোরা দরজা থাকে এবং সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সেটা রান্নাঘরের পিছন দিকে। আমাদের হোস্টেলেও ছিল। কিছুক্ষণ পরে বিল্টুর ঘরের আলো নিভে গেল। তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রায় চল্লিশ কিলোগ্রাম ওজনের একটা ধাউস কাঁঠাল ধরাধরি করে সেই দরজা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সোজা দোতালার একটা ঘরে। এরপরে যা হবার তাই হয়েছে। হাতে ভালো করে তেল লাগিয়ে কাঁঠাল ভাঙ্গা ও কাঁঠাল খাওয়া, অবশেষে কাঁঠাল খাওয়ার প্রতিযোগিতাও হল সেই রাতে। ভোর হবার কিছুক্ষণ আগে যা যা পরে ছিল সেগুলো হোস্টেলের পেছনের পুকুরে ফেলে দিয়ে কাঁঠালের এনসাইক্লোপিডিয়া শেষ করা হল।
পরের দিন সকালে একটু দেরীতে হলেও রোজকার নিয়ম মত বিল্টু যথারীতি হোস্টেলে এসে হাজির। আমাদের কাঁঠাল খাওয়া দলের অনেকেই তখন ঘুমাচ্ছে, আর যে যখনই উঠছে প্রথমেই পাকা কাঁঠালের ঢেঁকুর তুলছে। আমরা সকালের চা নিয়ে এক জায়গায় জড় হয়েছি, বিল্টুও আছে তার মধ্যে।
বিল্টু বলল, জানিস তো কাল রাতে চোর এসেছিল আমাদের বাড়িতে। বড় কাঁঠালটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
বোঝা গেল গত রাতের ওষুধটা আবার দিতে হবে। আমাদের মধ্যে একজন বলল,
– চুপ কর। চোরের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, কাঁঠাল চুরি করতে আসবে অত রাতে। দ্যাখ গিয়ে ভালো করে, ঠিকই আছে।
সকালের প্রথম চা পেটে পরেছে এবং কথাটা এত জোড়ের সাথে আর বেগ নিয়ে বলেছিল যে, বলা মাত্রই আ-উ করে একটা ঢেঁকুর তুলল। বদ হজমের ঢেঁকুরের গন্ধ এমনিতেই সহ্য করা যায় না, তাতে যদি পাকা কাঁঠালের গন্ধও মিশে থাকে – সেটা বর্ণনা না করতে যাওয়াই শোভনীয় ব্যাপার। এক মুহূর্তে আমরা সবাই নিজের জায়গা থেকে পাঁচ-ছ পা পিছিয়ে গেছি। বিল্টু কিন্তু ওর পাশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করল – এটা কি হল?
— শেষ —