Home » ছোট গল্প » চতুর্দশী » সুজিতকে র‍্যাগিঙ

সুজিতকে র‍্যাগিঙ

কোন এক কাজে সেদিন হোস্টেলে অল্প রাত করে ফিরেছি। ফিরতেই সবার মুখে এক কথা – এই একটু আগে ফার্স্ট ইয়ারের সুজিত দাস আমাদের সবাইকে ধর্ষণ করে দিয়ে গেল। ইস, তুই যদি থাকতিস! আর যারা ধর্ষিত হয়েছে হাহা করে হাসছে – পরমানন্দে। কোন হেঁয়ালি নয়। ঘটনাটা একটু গোড়া থেকে বলা প্রয়োজন।

আসল কথাটা ঠিক ধর্ষণ নয়, তবে তারই একটা চলতি প্রতিশব্দ খুব চলত হোস্টেলে সেইসময়। যেমন, কাউকে জিজ্ঞেস করা হল, পরীক্ষা কেমন দিলি? সে বলল, পুরো ধর্ষণ করে দিয়েছি আজ। অর্থাৎ, পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। অথবা, মাংস রান্নাটা এতো ভালো হয়েছে যে অনেক ভাত খেয়েছে। সেটা বোঝাতে বলল, আজ মাংস-ভাত ধর্ষণ করে এলাম। কিংবা, কাউকে টেবিল টেনিস খেলায় গো-হারা হারিয়ে বলল, অমুককে টিটিতে আজ ধর্ষণ করে দিয়েছি। এইরকম একটা জঘন্য শব্দকে সার্বজনীন ভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্র একমাত্র হোস্টেলেই সম্ভব। কদাচিৎ হোস্টেলের বাইরে মুখ ফসকে সে কথা বেড়িয়ে গিয়ে দু-একজন যে লজ্জায় পরে নি তেমন নয়। সে যাই হোক, ধর্ষিত হয়েও খুশি হওয়ার কি থাকতে পারে সেইটেই বলি।

হোস্টেলে প্রথম এলে র‍্যাগিঙ করা হত – সেই সময়ে সব হস্টেলেরই এই একটা প্রথা ছিল। র‍্যাগিঙ-এর নামে যেসময়ে দৈহিক অত্যাচার করা হত – এটা তার ঠিক পরের যুগ। কলেজ থেকে কড়া নির্দেশ ছিল, যাদের নামে কোন রকম নালিশ আসবে তাদের কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হবে এবং তার একটা-দুটো নমুনাও ছিল। সুতরাং, এইসময়ে নানারকম মগজ-মারি এবং সাইকোলজিক্যাল প্রশ্নের উদ্ভাবন হয়েছিল। হোস্টেল কূটনীতির আরেকটা দিক হল, নিজের গোষ্ঠীর বা পরিচিতদের সেই র‍্যাগিঙ থেকে একটু রক্ষা করা। সাধারনত এই গোষ্ঠী তৈরি হত – এক স্কুল, এক শহর বা এক ডিপার্টমেন্ট – এইসবের ভিত্তিতে।

আমার সহপাঠিনী প্রেমিকার সাথে কলেজের পরে ঘণ্টা খানেক গল্প করার সময়। একদিন কিছু একটা রোমান্টিক কথা মনে মনে বারকয়েক আউরে বলতে যাব, আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, তোদের হোস্টেলে সুজিত দাস বলে একজন এসেছে। ও আমাদেরই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। চিনিস?

বললাম, হ্যাঁ, অল্প-স্বল্প চিনি, মালদার ছেলে। তুই কি চিনতিস?

বলল, বাবার কাছে মাঝে মধ্যে আসে – কবিতা, গল্প, ডিবেট নিয়ে আলোচনা করতে।

মনে মনে ভাবলাম, মালদার কোন বুদ্ধিজীবীটা না আসে অমিত সার্বজনীন-দার কাছে। কিন্তু মুখে বললাম, দু-একবার ওকে স্টেজে বলতে শুনেছি। ভালো বলে, এর বেশি আর কিছু মনে নেই।

সে বলল, শোন, তুই কিন্তু ওকে র‍্যাগিঙ করিস না। আর তোর বন্ধুদেরও বলে দিস।

প্রেমিকার অনুরোধ কুড়ি বছরের কোন যুবক রাখবে না – তাই কখনো হয়? এতো অর্জুনের একাগ্নি বান বা নিউটন-ল মতই কার্যকরী – হয়তো বা তার থেকে কিঞ্চিত বেশীই। প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে আমাকে আকাশে উড়তে বলে নি, উঁচু ব্রিজের উপর থেকে ঝাপ দিতে বলে নি, এতো অতি সামান্য কাজ। আসলে, অকাজ-কুকাজ না-করারই অনুরোধ। সেইটে মাথায় ঢোকার পরে খুশিতে ডগমগ হয়ে চব্বিশখানা দাঁত বের করে বললাম, সে না হয় হল। তবে সারা হোস্টেলের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।

সে বলল, তুই করিস না, আর তোর বন্ধুদের বলে দিস। আমি এর থেকে আর বেশী কিছু চাই না।

ওরে বাবা! এরমধ্যে ঠুস করে একখানা চাওয়া এসে গেল। আর বেশী কথা বাড়ালে, আরও যে কি কি এসে ঢুকবে সেটা আন্দাজ করতে না-পেরে তাড়াতাড়ি বললাম, ঠিক আছে তাই করবো। তবে ছেলেটাকে হোস্টেলে সবাই বড্ড পাকা ছেলে বলে। এইটাই বিপদ।

সে জিজ্ঞেস করল, তুই কি ওর মধ্যে কোন পাকামি দেখেছিস?

বললাম, না, সেরকম কিছু দেখি নি। তবে খুব ফিটফাট হয়ে কলেজে যায়, আর ও বেশ লম্বা। সেটাই বোধহয় এর কারণ হবে।

আমি যে এই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি, সেইটে বোঝানর জন্যে বললাম, আমি সুজিতকে গিয়ে বলতে পারি, যাতে ও একটু কুঁজো হয়ে হাটে কিছুদিন। কিন্তু লম্বা ছেলে কুঁজো হয়ে হাঁটলে সবাই ওকে আঁতেল বলবে। ওতে বিপদ আরো বাড়বে।

কি ভাবল কে জানে। বলল, চল, এবার যেতে হবে আমাকে।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে, আমাদের তাসের আড্ডা বসে। সেখান থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তিনজনকে ডেকে ব্যাল্কনিতে নিয়ে গিয়ে সুজিতের বিষয়টা বললাম। আর, মনে মনে ভাবছি, ছেলেটা আমাকে মন্ত্রী-বড়ের কোনাকুনি চালে ভালোই ফাঁসিয়েছে। ধারনা ছিল না যে এ মাল আমার থেকে আরও অনেক বেশী সরেস। আমি বলামাত্র বাকিরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একে একে বলল যে তাদেরকেও তাদের বিশেষ কেউ একই রকম অনুরোধ করেছে। তাদের অবস্থা আমার থেকেও সঙ্গিন – যেন এর উপরেই তাদের বাকি জীবনের প্রেম-ভালবাসার অধ্যায়টা নির্ভর করছে। ভাবছি, আমি তো মন্ত্রী খাইয়ে রাজা বাঁচাবো। এরা তো গজ-নৌকার সোজাসুজি-কোনাকুনি চালে এমন ফেঁসেছে যে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঠিক হল, ওকে র‍্যাগিঙ করতে ডাকবই না – তাতে সবদিকই রক্ষা হবে। ব্যাটা ভুগুক মানসিক চাপে। এর চাইতে ভালো কোন উপায় বের করতে না পারায় সেইটেই ঠিক হল, সবাইকে সেইরকমই বলা হল এবং সবাই মেনেও নিলো।

তারপরে একদিন কোন এক নগণ্য কারণে পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে, রাতে খাওয়ার পরে হঠাৎ করে সবাই মিলে সুজিতকে তলব করেছিল – সুজিত, অমুক ঘরে আয়, তোর সাথে একটু আলাপ করব। এর মানেটা খুবই সহজবোধ্য। এরপর, তোর নাম কি? তোর বাবার নাম কি? বাড়ীতে আর কে কে আছে? বাবা কি করেন? কি নিয়ে পড়ছিস? কেন পড়ছিস? বড় হলে কি হবি? ইত্যাদি নিয়ম মাফিক প্রশ্নোত্তরের পরে যেই জিজ্ঞেস করেছে বাংলা সিনেমার কোন নায়িকা তোর সবচেয়ে প্রিয়?

সুজিত উত্তর দিল, সন্ধারানি।

সাজেশনের বাইরের প্রশ্ন এলে পরীক্ষার্থীদের যেমন অবস্থা হয়, যারা পরের ধাপের প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল তাদের সেইরকম অবস্থা হল। সাজেশনের উত্তর হল, সুচিত্রা সেন বা অপর্ণা সেন। এই দুই নায়িকা জীবনে যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু করেন নি, তার পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া সাজেশনের মধ্যে – সুতরাং সেগুলো সবার মুখস্থ। এর মধ্যে একবার ঢোকাতে পারলে ব্যাস আর কথা নেই – কথা ও তথ্যের প্যাচে ফেলে যে কাউকে কুপোকাত করা বড়জোর পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু ‘সন্ধারানি’ – এতো সাজেশনের বাইরে!

সে যাই হোক, এতজন মহারথীর মধ্যে এক অভিমুন্য কতদূরই বা যাবে?

পরের প্রশ্ন – কেন রে? সুচিত্রা সেনকে ভালো লাগে না? উদ্দেশ্য একটাই – ঢোক একবার চক্রবুহ্যের মধ্যে, তারপরে দেখছি কি করে সেখান থেকে বের হোস।

সুজিত বলল, আমি তো বলি নি যে সুচিত্রা সেনকে আমার ভালো লাগে না। তবে –

– তবে আবার কি? সোজাসুজি বল।

সুজিত বলল, এনাদের সবাইকে আমার ভালো লাগে তাঁদের অভিনয় ক্ষমতা দেখে। সুচিত্রা সেন খুবই ভালো, তবে –

– আবার তবে? মারবো এমন এক লাথি যে তোর ‘তবে’ বের হয়ে যাবে।

সুজিত বলল, ওনাকে তো শুধু বড়লোকের নেকু-পুচু মেয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে, ভুরু উঁচিয়ে প্রেম করার অভিনয়েই দেখি; ওটাই ওনাকে মানায়; হয়ত উনি শুধু ওটাই পারেন। সন্ধারানি সেটাও যেমন পারেন, তেমনি রাজরানি, গরীব বাড়ীর বউ, বা ঝিয়ের পার্টও একই রকমভাবে করতে পারেন। তাই –

সারা ঘর তখন স্তব্ধ। চক্রবুহ্যের বাইরে থেকেই সবাইকে একসাথে বলাৎকার করে এই ছেলে তখন সবার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

এরপরে এইরকম নানান প্রশ্নের উত্তরের পরে যখন ওকে কবিতা আবৃতি করতে বলেছে, ব্যাস আর যায় কোথায়? বাজ পাখির মত তীক্ষ্ণ চোখে সবার চোখে চোখ রেখে যখন বলে গেল, এতদিন কোথায় ছিলেন? ঘরের মধ্যে সবাই তখন পুরো ধর্ষিত। বনলতা সেনের পরে অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, অবনি বাড়ি আছো, আরো কিছু কবিতা আবৃতি করে, শেষে আর আদেশ নয়, ধর্ষিতদের অনুরোধে নিজের লেখা দুটো কবিতাবৃতি শুনিয়ে সবার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

আমি তখন হোস্টেলে ঢুকছি। একগাদা ছেলে ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখে একই কথা, ইস, তুই যে কি মিস করলি না! সুজিত সবাইকে কিভাবে যে ধর্ষণ করে চলে গেল না যে কি বলব।

আমি দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বললাম, আমার ঘরে আয়। আমি হিটারে চা বসাচ্ছি।

— শেষ —