।। এক ।।
কেউ যখন কারুর সামনে উপস্থিত থেকে নিজের অস্তিত্ব বোঝায় সেই অস্তিত্বের একটা পরিসীমা থাকে। যখন কেউ সামনে না-থেকে তার উপস্থিতি বজায় রাখে তার কোন প্রাকৃতিক সীমা থাকে না। সে থাকে ব্যক্তির অনুভবের মধ্যে। রতনের একমুখী জীবনে ঘটনাচক্রে শম্পা এসে পরেছিল। আরেকটা ঘটনায় সে চলে গেছে। কিন্তু এই কয়েকদিনে শম্পা রতনের জীবনে অনেকগুলো পাকা দাগ কেটে দিয়ে গেছে। শম্পা চলে গেছে তবে রতনের ঘরের মধ্যে সমস্ত জিনিষগুলো শম্পার উপস্থিতি এখনো টিকিয়ে রেখেছে। সারাক্ষণ রতনের মনের মধ্যে ‘এখন কি করা যায়’ এই চিন্তা ছট-পট করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এদিকে চাকরীতে রতনের একটা পদোন্নতি হয়েছে। শম্পা চলে যাওয়ার পরের দিন রতন চাকরীতে ইস্তফার চিঠিটা ফেরত আনতে গিয়েছিল বড় সাহেবের ঘরে। রতন কিছু বলার আগেই, বড় সাহেব বলল, ‘জানি একটা জিনিস তোমার পাওনা হয়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরে। এই নাও।’ বলে একটা প্রোমোশন লেটার রতনের দিকে এগিয়ে দিল। তারপরে বলল, ‘ভেবে দেখ তুমি এটা নেবে নাকি সত্যি কাজটা ছেড়ে দেবে? দুই-একদিন ভেবে তারপরে না-হয় বোলো।’ রতন প্রোমোশন-লেটারটা নিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে বের হয়ে গেল।
দু-দিন পরে কাজ করার সম্মতি জানিয়ে রতন ইস্তফার চিঠিটা ফেরত নিয়ে নিল। তারপর থেকে রতনের নতুন দায়িত্ব এবং মাইনে বেশী। খবরটা চাপা থাকে নি। সবাই জানে যে রতন কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিতেই মালিক ওকে একেবারে দুই-ধাপ প্রোমোশন দিয়েছে। অনেকে রতনকে কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে বলল, একেই বলে সাহস। কেউ কেউ ভাবল, এর পিছনে নিশ্চয় কোন বড় চাল আছে; অনেকেই এখানে বহুদিন ধরে কাজ করেছে, এভাবে প্রোমোশন পেতে কাউকে দেখে নি।
রতন বুঝতে পারল যে ধার শোধ হয়ে গেছে; ওর আর কোন বাধা নেই। তাই ওকে আটকানোর জন্যে প্রোমোশনটা দিল। এর আগে কত লোক ওর পরে কাজে ঢুকে প্রোমোশন পেয়েছে, আর ও যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গিয়েছে। পুরানো কথা ভেবে কাজ নেই, আরেক ধাপ উঠলেই অফিসার র্যাঙ্ক – এই চিন্তা মাথায় নিয়ে রতন কাজে মন দিল।
অফিসের এই অংশটা অনেক ভালো, পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। অনেকদিন ধরে এই কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে রতন প্রায় সবাইকে চেনে। দায়িত্ব নতুন হলেও লোকগুলো সবই পরিচিত। আর যাদের সাথে পরিচয় ছিল না তাদের সাথে খাতির জমিয়ে নিতে তেমন কোন অসুবিধা হল না। এখানে রতনকে কেউ রত্নাকর, কেউবা রত্নাকর-বাবু বলে ডাকে। নামের এই সু-ব্যবহার রতনকে আশ্চর্য করল। কোনদিন ভাবে নি যে কেউ ওকে ওই নামে অফিসে ডাকবে। রতনের হঠাৎ করে প্রমোশনের কারণে ও যেমন অনেকের ঈর্ষার কারণ হল, সেইরকম অনেকের ভালোবাসার পাত্রও হল। অনেক কিছুর মধ্যে রতন প্রথমেই যেটা বুঝতে পারল তা হল, কারখানার পরিবেশ আর অফিসের পরিবেশ একদম অন্যরকম। এখানে কাজের বাইরেও অনেক ব্যাপার চলে। অন্য লোকের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সকলের আগ্রহটা বেশ অনেকখানি। এই চার-দেওয়ালের মধ্যে বসেই সবাই অন্যের খবর রাখে। যেমন, অফিসের ভিতরে এবং অফিসের বাইরে বড় সাহেবের সাথে কার কি সম্পর্ক, এই ঘরের মধ্যে কে কাকে পছন্দ করে বা কে কাকে দুচোখে দেখতে পারে না। আট-ঘণ্টার কাজটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ এই পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকাটাও একই রকম দরকার। তা না-হলে নানান বিপদ।
রতনের পাশের টেবিলে মাঝবয়সী এক মহিলা বসে। সবাই তাকে কনিকাদি বলে ডাকে। কনিকাদি সময় পেলেই রতনের টেবিলের উপরে হুমড়ি খেয়ে পরে আর একেকদিন একেকটা পর্ব বলে শেষ করে। শুনে কনিকাদিকে অফিসের একটা আর্কাইভ বলে মনে হয় রতনের।
একদিন লাঞ্চের পরে কনিকাদি রতনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি রত্নাকর, তুমি গেলে না বড় সাহেবের মিটিঙে? রত্নাকর বলল, আমাকে উনি ডাকেন নি তো। কনিকাদি বলল, এখানে শুধু কাজ করলে হয় না। বড় সাহেবকে কাজ দেখাতে হয়। নাহলে দেখবে, তুমি খেটে-খুটে সব ফলাবে, আর ফসল তুলে নিয়ে যাবে অন্য কেউ।
রতন সাধারণত কিছু জিজ্ঞেস করে না। চুপ করে থাকলেও ওর এইসব জানতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কনিকাদি নিজেই একটা প্রশ্ন করে আর নিজেই তার বিস্তারিত বর্ণনা সহ উত্তর দেয়। আজ হঠাৎ রতন জিজ্ঞেস করে বসল, আপনি গেলেন না কেন মিটিঙে?
কনিকাদি চট করে আশপাশটা একবার দেখে নিয়ে রতনের গায়ের সাথে এমনভাবে সেঁটে দাঁড়াল যে জাপটে ধরলেও এর থেকে বেশী অঙ্গ স্পর্শ হত না। তারপরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, একটা সময় ছিল যখন সব মিটিঙে আমি না-গেলে কোন কাজ হত না। অফিসের পরেও অনেকদিন অনেকক্ষণ থাকতে হত আমাকে। এই বলে রতনের হাতের সাথে গায়ের একটা অংশ একটু ঘসে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
টুক করে ঘটে যাওয়া এই ছোট্ট ঘটনাটাকে রতন কিভাবে নেবে তা বুঝতে না-পেরে কনিকাদির মুখের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকল। তখন কনিকাদিও রতনের দিকে মিটিমিটি চোখে দেখছে। রতনের মনে হল কনিকাদি নির্বাক তবে অনেককিছু যেন বলে যাচ্ছে। কনিকাদি রতনের ঠিক এই মনোযোগটার অপেক্ষায় ছিল। কয়েক মুহূর্ত গেল। তারপরে কনিকাদি গলাটা একটু তুলে বলল, আরও কয়েকদিন যাক সবই পরিষ্কার বুঝতে পারবে। তারপরে অনেকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলল, আমিও ছেড়ে দেব না। বয়েস হয়েছে তো কি? অভিজ্ঞতাও আমার কোন হয় নি, আর এই কোম্পানির আনাচ-কানাচ আমার থেকে কেউ ভালো জানে না।
রতনের মনে হল, অসাবধানে ঘষলে একটা ভিজে যাওয়া দেশলাইয়ের কাঠি ফস করে জ্বলে নিভে গেলেও যেমন বোঝা যায় সে শুকনো থাকলে সেটা কি সাংঘাতিক হতে পারত! কনিকাদির চোখদুটো সেই রকম এক-ঝলক একটা দ্যুতি দিয়েই শান্ত হয়ে গেল।
রতন অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় জেনে খুব একটা মজা পায় না। কনিকাদির ইঙ্গিতটা যে বড় সাহেবের দিকে তা ভালোই বুঝল। বড় সাহেবের বিষয়ে যে এই প্রথম শুনছে, তা নয়। এর আগেও শুনেছে। তবে রতন ভাবে, ওসব জেনে ওর কি হবে? তার উপর একদিন এই লোকটার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছিল। সেই কারণে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করে রতনের ভিতরে।
অফিসের এই টানা লম্বা ঘরের অন্যদিকে তখন কয়েকজন বসে কাজ কর ছিল। রতন তাদের দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ ওকে দেখল কিনা। কিছু বুঝতে পারল না। রতন তাড়াতাড়ি নিজের চেয়ারে বসে একটা ফাইল নিয়ে মাথা গুঁজে বসে পড়ল। আর ভিতরে ভিতরে ঘেমে উঠল। কনিকাদির দুমুখো তীরের অন্যদিকটা কার দিকে সেটা রতন জানে। মল্লিকা নামে এক কমবয়সী মেয়ে সেই অফিসে কাজ করে। আধুনিক মেয়ে। দেখতে সুন্দরী, তবে শুনতে আরও ভালো। সকলের সাথে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কথা বলে। সকলেই পছন্দ করে। যে কারণে হোক না কেন, বড় সাহেব তাকে একটু বেশী ডাকাডাকি করে। সেটা যে রতনের চোখে পরে নি তা নয়। তবে ওইটুকুই।
দিন কয়েক আগে একদিন মল্লিকা এসেছিল রতনের কাছে একটা কাজে। কনিকাদি তখন রতনকে ফিসফিস করে কিছু বলছিল। মল্লিকাকে দেখে ফস করে চুপ করে গেল। তারপরে রতনকে বলল, রত্নাকর, আমি এখন যাই। মল্লিকার এখন তোমাকে দরকার।
মল্লিকা একটু শব্দ করে হেসে বলল, জানো তো কনিকাদি, তোমার উপর আমার বড্ড হিংসে হয়। বড় সাহেব কেন যে রত্নাকর বাবুকে তোমার পাশের টেবিলটা দিলেন বলো তো? উনি আমার পাশে বসলে বেশী মানাত না?
কনিকাদি বলল, তো যাও না, বড় সাহেবকে বলে চেঞ্জ করে নাও। তোমার সাথে তো ওনার। এই বলে কনিকাদি চুপ করে গেলেন। ইঙ্গিতই এখানে যথেষ্ট।
মল্লিকা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাসতে হাসতে বলল, সেটা যে ভাবিনি, তা নয়। তবে আমি বললে বড় সাহেব হয়ত আমাকে না-করে দেবেন, তোমাকে উনি না-করতে পারবেন না। প্লিজ তুমি একদিন বোলো না।
রতনকে মাঝখানে রেখে দুইজনের এইসব কথাবার্তা, তাও বড় সাহেবকে নিয়ে, রতনের ভাল লাগছিল না। রতন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মল্লিকা আপনার কি চাই? কাজের কথা বলেন। ওসব কথা আমার ভাল লাগছে না।
কনিকাদি চলে গেল নিজের টেবিলে। মল্লিকা বলল, কাজের কথা বলতেই এসেছি। তারপর একটা চেয়ার টেনে পারচেজ অর্ডার আর ভেন্ডার পেমেন্টের ফাইল খুলে রতনের পাশে বসে পড়ল। রতনের কাছে বিষয়টা নতুন। তাই বারবার মল্লিকার কাছে বুঝতে হচ্ছে। এত গোলমেলে বিষয় মেয়েটা যেভাবে বোঝাল, দেখে রতন অবাক হয়ে গেল। এখানে সব হিসাব পরিষ্কার নয়। গোলমেলে করে রাখাটাই নিয়ম। কমিশন কখনো ক্যাশে, কখনো চেকে; একই জিনিসে কোনোখানে ডিসকাউন্ট, তো অন্য-খানে সার-চার্জ; একটা সঠিক নামে, তো অন্যটা বেনামে। এমন গোলমেলে বিষয়, অথচ মল্লিকা সব হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিল। মল্লিকার সাথে কাজ করে রতন মুগ্ধ হয়ে গেল।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25