Home » নাটক » অস্তিত্ব

অস্তিত্ব

( দীপু মাহমুদের ছোট গল্প “একসাথে আছি, ভালো আছি” অবলম্বনে )

নাট্যরূপঃ কল্লোল নন্দী

চরিত্র (প্রথম অভিনয় ২০২০):

শাবিন – কৌশিক বর্ধন

রিদি (শাবিনের স্ত্রী) – চৈতালী দে

বুয়া (বাড়ির কাজের লোক) – দেবারতি মিত্র

রবিন (শাবিনের ভাই) – দেবতীর্থ বসু

SETTING:

সকাল বেলা। ড্রয়িং রুম। টেবিলে খালি চায়ের কাপ, কিছু ফাইল, বন্ধ ল্যাপটপ, পেন ইত্যাদি। প্রথম সিনে রিদিকে দেখা যাবে না, শুধু কথা শোনা যাবে।

AT RISE:

শাবিন সোফায় বসে। বুয়া সোফা পরিষ্কার করছে।

।। সিন – ১ ।।

শাবিন

    ( বুয়াকে )

আরেক কাপ চা হবে?

বুয়া

    ( তোয়ালা রেখে )

বসাচ্ছি, দাদা।

    ( ভিতরের ঘরে চলে যায়। )

রিদি

আবার চা? অফিস যাবে না আজ?

শাবিন

না, আজ আর অফিস যাব না।

রিদি

অফিস যখন যাচ্ছ না, তখন বাজার থেকে ঘুরে এসো। বসেই তো আছ!

শাবিন

অফিস যাব না। তবে, এখুনি অফিসের কাজ নিয়ে বসতে হবে। একটা জরুরি রিপোর্ট লিখতে হবে। আজই সাবমিট করার লাস্ট ডেট।

রিদি

আমি চাকরি করলে না – তোমার এই অফিস নিয়ে ভুজুংভাজুং বের হয়ে যেত।

শাবিন

করলেই তো পারতে। কে তোমাকে চাকরি করতে না করেছে?

রিদি

থাক সেসব কথা। এখন যাও, চট করে বাজারটা করে নিয়ে এসো।

    ( বুয়া এক কাপ চা নিয়ে ঢোকে। সাথে দুটো টেবলেট। টেবিলে রাখে। )

বুয়া

ঘরে রান্নার সবজি-পাতি কিছু নেই। বাজারে যেতে হবে তো।

শাবিন

    ( টাকা বের করে বুয়াকে দেয় )

এই নাও। যা যা লাগবে – দরোয়ানকে বলে দাও। ও এনে দেবে।

রিদি

তুমি হচ্ছো একটা পাড় অলস।

শাবিন

বাজারে না গেলেই একজন মানুষ অলস হয়ে যায়? আজ ভালো লাগছে না।

বুয়া

আপনার শরীরটা কি খারাপ লাগছে? সকালের ওষুধটা খেয়ে নিন। শরীর ভালো না লাগলে আরেকটু ঘুমিয়ে নিন। রান্না হলে আপনাকে ডেকে দেব।

শাবিন

আজ কি রান্না হবে?

বুয়া

ফ্রিজে মাছ আছে। আর দেখি দরোয়ান কি নিয়ে আসে।

    ( বুয়া বের হয়ে যায় )

।। সিন – ২ ।।

( টেবিলে সেল ফোন, ফাইল, ল্যাপ্টপ ইত্যাদি আছে। শাবিন অফিস যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। ঘরে রিদি একা বসে নিজের মনে যেন একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে খেলা করছে। শাবিন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে। )

রিদি

    ( শাবিনকে বলে )

এই, দরজাটা বন্ধ করে করে দাও না।

    ( কাল্পনিক তিতুনকে বলে )

তিতুন সোনা – আজ তোকে একটা নতুন ছড়া শেখাব। বল। আমার সাথে সাথে বল। বুঝলি? আম পাতা জোড়া জোড়া, মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া, ওরে বুবু সরে দাঁড়া, আসছে আমার পাগলা ঘোড়া …..

শাবিন

রিদি! কি তিতুন-তিতুন করছ? তিতুন নেই। আমাদের কোনো সন্তান নেই। যার আসার কথা ছিল সে আসেনি। তোমার গর্ভে তার মৃত্যু হয়েছে। এতদিন হয়ে গেল – কেন যে এই সত্যিটা মেনে নিতে পারছ না এখনো!

    ( রিদির কাঁধ ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় )

রিদি

তুমি একটা মিত্থুক। মহা-মিত্থুক। এই তো তিতুন। তুমি এখান থেকে যাও তো এখন। নিজের কাজ করো গিয়ে। যাও। আয় তিতুন, আমরা কানামাছি খেলি। আমার চোখ বাঁধা হয়ে গেলে তুই করবি কী…

শাবিন

রিদি কার সাথে একা একা কথা বলছ? সাড়ে চার মাসের তোমার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তুমি সবই জানো। এইবার একটু স্বাভাবিক হও। এইসব থামাও এবার।

রিদি

তুমি কি নিষ্ঠুর গো! নিজের সন্তান সম্পর্কে এইরকম কথা বলতে তোমার মুখে আটকাল না?

    ( কাল্পনিক তিতুনকে বলে )

তিতুন, তোর বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আয় আমরা অন্য কিছু খেলি।

    ( রিদি ঘরের বাইরে যেতে গিয়ে শাবিনের সামনা-সামনি আসে। কিছু একটা ভাবে শাবিনকে টেনে পাশে বসায়। দুজনে গোল হয়ে বসে খেলা শুরু করে )

আগডুম, বাগডুম, তাড়াতাড়ি, যদু মাষ্টার…

    ( কাল্পনিক তিতুনকে খুঁজে পায় না )

তিতুন কোথায় গেলি? কোথায় গেলি? …

    ( বলতে বলতে রিদি বের হয়ে যায়। শাবিন সে দিকে তাকিয়ে থাকে। )

শাবিন

    ( ধীরে ধীরে ওঠে। ফোন করে )

হ্যালো। ডক্টর চৌধুরী? আমি শাবিন বলছি। রিদির রিপোর্টটা কি এসেছে? রিদির তো কোন উন্নতি নেই। একই রকম আছে। ওর স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ। ওষুধগুলো রোজই খাওয়ানো হচ্ছে। ও তো কিছুতেই যেতে চায় না। দেখছি। আগামী সপ্তাহে একদিন নিয়ে যাব।

রিদি

    ( ঘরে ঢোকে, শাবিনকে বলে )

এই শোনো – আমার চোখ বেঁধে দাও তো। তুমি কিন্তু তিতুনকে কিছু বলে দেবে না।

    ( কল্পনিক তিতুনকে বলে )

তিতুন, আমি তোকে ছুঁতে পারলে, পরেরবার তোর চোখ বাঁধা হবে। তুই কিন্তু এই ঘরের বাইরে যেতে পারবি না। বুঝলি?

    ( শাবিনকে বলে )

আঃ তুমি যাও না। তুমি তোমার অফিসের কাজ কর গিয়ে যাও। যাও তো এখান থেকে।

শাবিন

ঊফফ! তুমি এইসব থামাবে এবার।

রিদি

    ( বিরক্ত হয়ে )

চল তিতুন, আমরা অন্য ঘরে গিয়ে খেলি।

    ( রিদি বের হয়ে যায় )

।। সিন – ৩ ।।

( সিন-১ এর continuation. শাবিন চোখ বুঁজে সোফায় বসে আছে। বুয়া তোয়ালায় হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে। )

বুয়া

রান্না প্রায় হয়ে এলো। আপনি কি এখন খাবেন?

শাবিন

না। পরে খাব। এক কাপ কফি বানিয়ে দাও না।

বুয়া

এই অবেলায় কফি খাবেন?

শাবিন

রিদিকে নিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এতদিন হয়ে গেল – ওর মাথা থেকে কিছুতেই তিতুন যাচ্ছে না। কিছুতেই সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না। প্রতিদিন একই কান্ড। কবে যে ও স্বাভাবিক হবে!

বুয়া

এখন খাবেন না যখন তো একটু ঘুমিয়ে নিন নাহয়। আজ বললেন, অফিসের কাজ আছে। কই এখনো তো কাজ নিয়ে বসলেন না।

শাবিন

কি করে বসব? সারাক্ষণ যদি বাড়ির মধ্যে একটা অবাস্তব ঘটনা নিয়ে নাটক চলে। কত চেষ্টাই তো করলাম। দিন দিন আবস্থা কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

বুয়া

আপনি কি নিজের চেহারাটা একবার দেখেছেন?

    ( সকালের ওষুধগুলো নজর করে )

এ কি? সকালের ওষুধগুলো তো একটাও খান নি এখনো।

    ( আদেশের মত করে )

আপনি আগে ওষুধগুলো খান তারপরে আপনাকে কফি করে দিচ্ছি। কি করে আমি যে এই বাড়িতে টিকে আছি? চোখের উপরে এসব দেখতেও পারি না, ছেড়েও যেতে পারছি না। ঊফফ!

    ( ডোর বেল বাজে। বুয়া বাইরের দরজা খুলে দেয় )

রবিন

    ( রবিন ঢোকে। এসে সোফায় বসে )

কাল সকাল সকাল স্নান করে রেডি থাকিস, দাদা। তোর মনে আছে তো?

শাবিন

কি মনে আছে?

রবিন

কাল সকালে তোর ডাক্তারের অপ্যোয়েন্টমেন্ট। আর সন্ধের সময়ে অনেকে আসবে এখানে।

শাবিন

কেন আসবে? কাল তো আমরা বাড়ি থাকব না।

রবিন

বাড়ি থাকবি না? কোথায় যাবি?

শাবিন

কাল আমরা একটা রোজ-শো (rose show) দেখতে যাব। তোর বউদি বলেছে প্যারাডাইস রোজ নামে এক গোলাপ আছে সেখানে। অসাধারণ ফুল!

    ( একটু অন্যমনস্ক, তারপরে যেন কিছু মনে পরে )

এই, তুই যাবি – আমাদের সাথে? বেশি দূরে না। গাড়ি নিয়ে যাব আর চলে আসব।

রবিন

দাদা! আগামীকাল বউদির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

শাবিন

ছিঃ ছিঃ ছিঃ। নিজের বউদিকে নিয়ে এইরকম কথা বলতে লজ্জা করল না? তুই কি জানিস না ওর অবস্থাটা…

রবিন

দাদা! বউদির ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, ছয়টা কেমো দিয়ে তারপরে টিউমারটা অপারেশন করবেন। চারটা কেমো নেওয়ার পর বউদি মারা গেলেন। কাল ঠিক এক বছর হবে। এখনো কেন যে – এই সত্যিটা মেনে নিতে পারছিস না দাদা?

শাবিন

চুপ চুপ। রিদি তিতুনের সাথে কানামাছি খেলছে ভিতরের ঘরে। শুনে নেবে। রিদি বাড়িতে ভিড় পছন্দ করে না একদম। এখানে ভিড় হলে রিদি এখান থেকে চলে যাবে। তুই এখন যা। আমরা ভালো আছি। তুই এখন যা।

    ( বুয়া দুই কাপ কফি নিয়ে ঢোকে। চোখের ইশারায় ওষুধগুলো দেখায় )

রবিন

দাদা ওষুধগুলো খেয়ে নে।

    ( জল দিয়ে ওষুধ খাওয়ায় )

চল, এখন একটু ঘুমিয়ে নে।

    ( শাবিন ধীরে ধীরে ওঠে। শোবার ঘরের দিকে চলে যায় )

রবিন

    ( বুয়াকে )

আজ আর কফি খাব না। তুমি ওর একটু খেয়াল রেখো।

    ( রবিন ঘর থেকে বের হওয়ার পথে রিদির ফোটোর সামনে একটু দাঁড়ায়। তারপরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। )

– শেষ –