রি-সাইকেল

গত রাতে শঙ্করের বাড়ীতে পার্টি হয়েছে। মুষলধারে কয়েক কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে যেমন এখানে জল, ওখানে কাঁদা, ওদিকে গাছের ডাল ভেঙ্গে পরে থাকে – এইসব জের কাটতে কয়েকদিন লাগে, বাড়ীতে পার্টি হয়ে যাওয়ার পরে তার জের কাটতে কয়েকদিন লাগে। আজ সকালটা সেইরকমই। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠে শঙ্কর ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে। হাতের কাছে টাইমস ম্যাগাজিন পেয়ে ওটার পাতা উল্টাচ্ছে। উমা এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট শঙ্করকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর কিছু খাবে? দুপুরে সোমাদের বাড়ীতে লাঞ্চ ইনভিটেশন আছে। দেরী করে যাওয়া চলবে না। উমা উত্তরের অপেক্ষা না করে রান্না ঘরে চলে গেল।

টাইমস ম্যাগাজিনটা পাশে সরিয়ে রেখে শঙ্কর মনে মনে ভাবতে লাগল, উমার কথার মধ্যে তো একটা প্রশ্ন ছিল – “আর কিছু খাবে”? উমা প্রশ্ন করল। উত্তরের অপেক্ষা করল না! তাহলে সব প্রশ্ন কি আসলে প্রশ্ন নয়? অনিচ্ছাকে প্রশ্নের মত করে বললে একটু বিনয়ী ভাব আসে। কুড়ি বছরের বেশী একসাথে সংসার করছে। উমা জানে ও এখন কিছু খাবে না। ওটা একটা কথার কথা মাত্র। কোন প্রশ্ন নয়।

এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে শঙ্কর চায়ে চুমুক দিল। ওদিকে রান্নাঘর থেকে ঘটাং ঘটাং করে শব্দ আসছে – উমা ডিস ওয়াসার থেকে বাসন তুলে রাখছে। শঙ্কর মনে মনে দশ গোনা শুরু করল। উমার পুরানো রেকর্ড চালু হল বলে – আমেরিকায় এসে কী হল? সব কাজ একা একা করতে হয়। দেশে সবাই এখন কত ভালো আছে… …

হলও তাই। এই “এখন”টা যে কখন সেটা আজও ঠিক করে বোঝা যায় নি। আর “কত ভালো”? সে প্রসঙ্গে কথা তুললে, হ্যাঁ, না, মানে, ইত্যাদি, ওই আর কি, সে তো একই হল – এর বেশী কথা এগোয় না। বিশ্বাসে বস্তু না মেলালেও, তর্কে সম্পর্ক দূরে চলে যায়। তাই শঙ্কর এই নিয়ে আর তর্ক করে না।

ক্লান্ত শরীরে সামান্য কাজও বেশী কাজ মনে হয়। গতকাল শুতে যেতে অনেক রাত হয়েছিল। সব গেস্ট যাওয়ার পরে ঘরে অনেক কাজ করতে হয়েছিল। মনে মনে উমাকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলেও শঙ্করের মাথাটা ভার হয়ে আছে। উঠতে ইচ্ছে করল না। ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসেই জিজ্ঞেস করল, এদিকে কি কিছু করতে হবে?

রান্নাঘর থেকে উত্তর এলো, গিফটগুলো তুলে রাখ। বসেই তো আছো। আর দেখো, রিনি যে ব্যাগটা দিয়েছে তাতে টিঙ্কুর জন্যে একটা ড্রেস আছে। ওটা মনে হয় চেঞ্জ করতে হবে। ওর ভিতরে একটা গিফট রিসিপ্ট আছে। সেটা আবার ফেলে দিও না। তোমার তো আবার সব ফেলে দেওয়ার ধাত।

চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে শঙ্কর গেস্ট-রুম থেকে সব গিফট ব্যাগগুলো এনে ডাইনিং টেবিলের উপরে জমা করল। তারপরে উমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি সব গিফটগুলো বের করে ফেলব না তোমার জন্যে অপেক্ষা করব?

উফ!! একটা মিনিট চুপ করে বসে থাকতে পারে না। আসছি আমি। আমার জন্যে একটু ওয়েট করতে পারো তো, উমা উত্তর দিল রান্নাঘর থেকে।

চুপ করে বসে থাকলে, সারাক্ষণ ঠুঁটো জগন্নাথ। আর কাজ করলে, একটা মিনিট চুপ করে বসে থাকতে পারে না। “তর্কে বহু দূর” – মন্ত্রটা মনে মনে দুইবার বলে শঙ্কর চায়ের কাপে মন দিল।

মিনিট দশেক পরে উমা রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে এল। চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কী অবস্থা হয়েছিল রান্নাঘরটার! আমাকেই সব করতে হয়। সংসারটা যেন আমার একার। বিক্রমকে দেখ। ও কত হেল্প করে সারাক্ষণ।

বিক্রম যেমন হেল্প করে তেমন…, বলেই “তর্কে বহু দূর” মন্ত্রটা মনে পরে গেল। কথা পালটে শঙ্কর বলল, একটা কাঁচি লাগবে। আমি নিয়ে আসছি।

শঙ্কর চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। চায়ের কাপটা সিঙ্কে নামিয়ে রেখে তাতে একটু জল ঢেলে দিল। তারপরে একটা কাঁচি নিয়ে যখন ডাইনিং টেবিলে এসে পৌঁছল, ততক্ষণে উমা গিফট ব্যাগগুলো থেকে কয়েকটা গিফট বের করে টেবিলের একপাশে আর গিফট ব্যাগগুলো ভাঁজ করে অন্য পাশে গুছিয়ে রেখেছে।

শঙ্কর একটা কাঁচের গ্লাসের সেট দেখে উমাকে বলল, তোমার মনে আছে, আমরা এদেশে আসার পরে পরেই কে যেন আমাদের ঠিক এইরকম গ্লাসের সেট দিয়েছিল। তার লাস্ট পিসটা কয়েকদিন আগে ভাঙল।

শঙ্করের কথাটায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে উমা রুপোর রঙের একটা নেকলেস নিজের গলায় ধরে শঙ্করের দিকে তাকাল। শঙ্করের দৃষ্টি ও মন তখনও সেই গ্লাসগুলোর দিকে। নস্টালজিয়ার একটা জলছবি – ওর চোখে-মুখে ডুবছে আর ভেসে উঠছে। উমা দেখল সেটা কিছুক্ষণ ধরে। শঙ্কর উমার দিকে তাকাতেই উমা বলল, গ্লাস দেখলে তো তোমার মাথার ঠিক থাকে না। সারা বাড়ীতে নানান রকম গ্লাসের বাহার করে রেখেছ। এই প্যাকেটটা একদম খুলবে না। এই বলে, উমা নেকলেসটা নামিয়ে বাক্সের মধ্যে রেখে দিল।

মাঝে মাঝে একটা-দুটো করে গ্লাস ভাঙ্গে, আর সেই কারণে রকমারি গ্লাসের ভিড় হয়েছে বাড়ীতে – শঙ্কর এই কথাটা বলতে গিয়েও “তর্কে বহু দূর” মন্ত্রটা মনে পরে গেল।

শঙ্কর টেবিলের অন্যদিক থেকে একটা র‍্যাপ করা গিফট টেনে কাঁচি দিয়ে কাটতে গিয়ে একটু থমকে গেল। র‍্যাপের কাগজটা একটু অন্য রকমের, খুব চেনা। প্রায় বছর দুয়েক আগে শঙ্কর এক ডজন এইরকম গিফট র‍্যাপ কিনেছিল। দোকানটা উঠে যাচ্ছিল বলে তখন সব কিছু নাইনটি পার্সেন্ট অফে বিক্রি হচ্ছিল। তার পরে শঙ্কর যেখানেই যায় ওই এক গিফট র‍্যাপ। চেনা মহলে ওটার নাম হয়ে গিয়েছিল শঙ্করের গিফট র‍্যাপ।

শঙ্কর গিফট র‍্যাপের ফিতেটা কাঁচি দিয়ে কেটে গিফট র‍্যাপটা ছিঁড়ল। ভিতর থেকে বের হল একটা নীল রঙের বাক্স। বাক্সের ঢাকনাটা খুলে দেখে একটা কাঠের হাতি। পেটের দিকটা ফাঁপা, জাফরির কাজ। আর বাক্সের ভিতরে একটা ছোট্ট গিফট নোট। তাতে লেখা,

বিক্রম,
আশাকরি তোমার নতুন বাড়ীর শো-কেসে এই হাতিটার একটা জায়গা হবে। তুমি কাঠের জিনিষ এত পছন্দ কর বলে উমা অনেক খুঁজে এটা তোমার জন্যে কিনেছে। কোন কারণে যদি এটা পছন্দ না হয়, বা অন্য জিনিষের পাশে বেমানান লাগে, এটা বদলে নিজের পছন্দ মত কিছু নিয়ে নিও। গিফট রিসিপ্ট হাতির পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। শত চেষ্টাতে সেটা হারাবে না।

শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল তোমাদের জন্যে, তোমাদের নতুন বাড়ির জন্যে।

– উমা ও শঙ্কর।

শঙ্কর হাতিটার পেটের ভিতরে তাকিয়ে দেখল গিফট রিসিপ্টটা যেমন ভাবে রেখেছিল তেমনই আছে। উমা তখন অন্য কিছু একটা দেখছিল। শঙ্কর উমাকে টেনে হাতিটা আর গিফট নোটটা দেখাল। উমা এক নজরে পড়ে বলল, What the!!!

স্কুলে পড়ার সময়ে শঙ্করের এক অদ্ভুত খেয়াল মাথায় চেপে ছিল। টাকার নোট পেলে সেটা কাউকে দেওয়ার আগে নোটের সাদা অংশে নিজের নাম লিখত। আশায় থাকত যদি কোন দিন সেই নোটটা তার কাছে ফেরত আসে। অনেকদিন চলেছিল, তবে কোনদিন নিজের নাম লেখা নোট ফেরত পায় নি। তারপরে কবে সেই নেশা কেটে গেছে শঙ্করের আজ মনে করতে পারল না।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উমা বলল, কাল তো বিক্রমদের নিমন্ত্রণ করি নি। আমার ঠিক মনে আছে, শ্যামল এটা আমার হাতে দিয়েছিল। র‍্যাপটা দেখে চেনা চেনা লেগেছিল তখন। মনে আছে সস্তায় পেয়ে তুমি এক র‍্যাপ কতগুলো কিনেছিলে? কিন্তু ব্যাপার হল, যতদূর জানি শ্যামল বিক্রমকে চেনে না। তাহলে?

ততক্ষণে টিঙ্কু ঘুম থেকে উঠে এসে টেবিলের অন্য দিকে দাঁড়িয়েছে। উমা শঙ্করকে বলল, তুমি এই চিপ-অ্যান্ড-ডিপ বাক্সটা ভালো করে র‍্যাপ করে বাকি গিফটগুলো ক্লসেটে তুলে রাখো। আর ভালো কোরে দেখে নিও ভিতরে নাম-টাম যেন লেখা না থাকে। আজ লাঞ্চে ওটাই সোমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। যাই, আমি টিঙ্কুকে খেতে দেই। এই বলে, উমা উঠে গেল।

— শেষ —